আদিবাসী ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার দাবি

বক্তব্য দিচ্ছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানছবি: আশরাফুল আলম

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে আদিবাসী পরিচয় উল্লেখ করে তাদের অধিকারের কথা বলেছিলেন। এ সরকারের বেশির ভাগ উপদেষ্টাও কোনো না কোনো সময়ে আদিবাসীদের দাবির প্রতি সম্পূর্ণ সহমত প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি আদিবাসীদের সঙ্গে যেসব ঘটনা ঘটছে, নিশ্চয়ই সেসব তাঁদের অজানা নয়। কিন্তু এখন কেন তাঁরা আদিবাসীদের বিষয়ে তাঁদের অবস্থান পরিষ্কার করছেন না?

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম আয়োজিত এক গণসমাবেশে উপস্থিত বক্তারা এ কথাগুলো বলেছেন। তাঁদের দাবি, অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই আদিবাসী ইস্যুতে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। আদিবাসীদের অধিকার, স্বীকৃতি ও দাবি-দাওয়া নিশ্চিতে এ সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে; না হলে ২৪-জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না।

আজ শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি আদায়ে আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম জোরদার করুন’ শিরোনামে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ থেকে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসী শব্দযুক্ত গ্রাফিতি পুনর্বহাল এবং আদিবাসী ছাত্র–জনতার ওপর গত ১৫ জানুয়ারি যারা হামলা চালিয়েছে, তাদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির দাবি জানানো হয়।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের প্রায় শতভাগ সদস্য আদিবাসী দাবির প্রতি, আদিবাসী পরিচয়ের প্রতি কোনো না কোনো সময় সম্পূর্ণ সহমত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা এখনো সেটা অন্তরে ধারণ করেন বলে বিশ্বাস করি। তাহলে কেন তাঁরা প্রকাশ্যে সেটা বলবেন না? আদিবাসী ইস্যুতে সরকারের অবস্থান কী, সেটা কেন তাঁরা স্পষ্ট করে বলছেন না।’

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জাতির প্রতি তাঁর প্রথম ভাষণে আদিবাসী শব্দ যেভাবে চয়ন করেছিলেন, আদিবাসীর পরিচয় উল্লেখ করে যেভাবে আদিবাসী অধিকারের কথা বলেছিলেন, সম্প্রতি ঘটনাগুলো তাঁর কাছে অজানা নয়। তিনি কেন তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করছেন না? অন্তর্বর্তী সরকারের পেছনের শক্তি কি এতই শক্তিশালী যে তাদের কাছে সরকারের নতি স্বীকার করতে হচ্ছে?

পাঠ্যপুস্তক থেকে গ্রাফিতি বাদ দেওয়ার বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, পাঠ্যপুস্তক থেকে যে গ্রাফিতি সরিয়ে দিয়েছে, যা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার মূল ধারক ছিল, আদিবাসী শব্দ মুছে দিতে সেটা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাঁরা এটা সরিয়েছেন, সেই শক্তির পেছনে কারা আছেন, সেটা বের করতে হবে।

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন করা হচ্ছে, সংস্কার প্রস্তাব করা হচ্ছে। কিন্তু আদিবাসীদের মতামত কীভাবে সংস্কারগুলোতে প্রতিফলিত হবে, সেটার জন্য কোনো আলাদা কমিশন গঠন করা হয়নি। সাংবিধানিক স্বীকৃতির যে বিষয়ে দাবি আসছে, সেই সংবিধান সংস্কার কমিশনেও আদিবাসীদের কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি। তাহলে তাদের মতামতের প্রতিফল ঘটবে কী করে? আদিবাসীদের সমস্যার সমাধান না করে, তাদের স্বীকৃতি না দিয়ে, ভূমির অধিকার, জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কীভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ হবে, সেটা বোধগম্য নয়।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘দুঃখ ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করলাম, অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য অঞ্চলে নতুন করে অত্যাচার শুরু হলো। সেখানে যে বাহিনী রাজত্ব করে, তাদের নতুন চেহারা লক্ষ করলাম। অভ্যুত্থানের বিজয়ের পর যে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে জনগণের ভাষা সামনে এসেছে, সেই ভাষাকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হলো। যে দায়িত্ব নিয়ে ওই গ্রাফিতি বাদ দিয়েছে, তার নাম প্রকাশ করতে হবে। অথবা এ দায় ইউনূস সরকারকে নিতে হবে।’

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি আদায়ে আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম জোরদার করুন’ শিরোনামে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়
ছবি: আশরাফুল আলম

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘আগে স্বৈরাচার সরকার আমাদের আদিবাসী বলতে দেয়নি, বারণ করেছে। এখনো কি তা–ই হবে? আর কোন একটি গ্রুপ এসে এনসিটিবিকে গ্রাফিতি বাদ দিতে বলল, আর তারা বন্ধ করে দিল! সরকার হামলাকারীদের ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেটা করছে না।’

গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হোসেন রুবেল বলেন, আদিবাসীদের আওয়াজ উঁচু করতে হবে। আওয়াজ যত উঁচু হবে, অন্য পক্ষের লোক তত আপনাদের কথা শুনতে বাধ্য হবে। আওয়াজ উঁচু করেই স্বীকৃতি ও অধিকার আদায় করতে হবে।

মতিঝিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ভবনের সামনে হামলায় গুরুতর আহত রূপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘তারা আমাদের নিঃশেষ করার জন্য মেরে ফেলতে চায়। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে সবাইকে এই লড়াইয়ে শামিল হতে হবে।’

ওই হামলায় গুরুতর আহত আরেকজন ডন যেত্রা বলেন, ‘যতই অন্যায়-অবিচার হোক, হামলা-নির্যাতন হোক, রক্ত দিয়েছি, আরও দিতেও প্রস্তুত আছি। হয়তো রাজপথে মরে যাব। তবু অধিকার আদায় করেই ঘরে ফিরব।’

গণসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহসভাপতি অজয় এ মৃ। সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি বিচিত্রা তির্কী, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নির্মল রোজারিও, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য কে এস মং, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজীম, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, আদিবাসী যুব ফোরামের সহসভাপতি টনি চিরান, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ প্রমুখ।

সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ইগ্নাসিয়াস হেমন্ত কোড়াইয়া, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক, আদিবাসী ফোরামের সহসাধারণ সম্পাদক গজেন্দ্রনাথ মাহাতো।

সমাবেশ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর আগে গারোদের ব্যান্ডদল দ্য রাবুগা বিপ্লবী গান পরিবেশন করে। এরপর জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশ শেষে আদিবাসীদের গানের দল মাদল গান পরিবেশন করে।