কাজ করতে গিয়ে ছোট্ট দেহ ক্ষতবিক্ষত, নেই সুরক্ষা
রাজধানীর গেন্ডারিয়ার একটি হার্ডওয়্যার কারখানায় কাজ করে সোহাগ (১৪)। তিন মাস আগে আরেক শিশু সহকর্মীর হাতে থাকা যন্ত্র থেকে বুলেটের মতো লোহার বড় পিন বেরিয়ে ঢুকে যায় সোহাগের পিঠে। তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে তার অস্ত্রোপচার করা হয়।
কুমিল্লার এই কিশোরের বাবা সাগর মিয়া, অটোরকিশা চালান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চার দিনে ছেলের চিকিৎসায় ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে তাঁর। কারখানার মালিক কোনো সহায়তা দেননি। মালিক মো. রাসেল বলেন, এক সহকর্মীর অসাবধানতায় আরেকজন আহত হয়েছে। এখানে তাঁর কোনো দায় নেই।
আবার নারায়ণগঞ্জ শহরের মৌচাক স্ট্যান্ডের কাছে একটি ভবনের ছাদ ঢালাইয়ের সময় জোগালির কাজ নিয়েছিল ১২ বছরের ইব্রাহিম। মিক্সচার মেশিনের চাকা পাম্প দেওয়ার জন্য রিকশা গ্যারেজে নিতে সেটি তার ঘাড়ে তুলে দেন প্রাপ্তবয়স্ক এক শ্রমিক। ছোট্ট দেহে ভারী চাকা নিয়ে হাঁটতে গিয়ে পড়ে যায় সে। হাসপাতালে চেতনা ফেরার পর ইব্রাহিম দেখে, তার শরীরের কোনো অংশেই অনুভূতি নেই। এখন পঙ্গু জীবন যাপন করতে হচ্ছে ইব্রাহিমকে।
সুরক্ষিত জীবনের সুযোগ না পাওয়া সোহাগ ও ইব্রাহিমের মতো বহু শিশুই দেশে ‘শিশুশ্রমের’ এক অমানবিক বাস্তবতায় ঢুকে যাচ্ছে। অসম কাজের ভার বহন করতে গিয়ে কেউ আহত হচ্ছে, কেউ পঙ্গু, কেউবা প্রাণটাই হারাচ্ছে। শিশুশ্রমের এ ভয়াবহতা থেকে শিশুদের রক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে আজ ১২ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘শিশুশ্রম বন্ধ করি, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করি’।
২০২৫ সালের মধ্যে সরকারের শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য রয়েছে। অথচ ২০২৩ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা আরও বেড়েছে। বড়দের কাজ ছোটদের দিয়ে করানো হচ্ছে বলে শিশুরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে সহজে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ প্রকাশিত ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’ জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের ৩১ শতাংশ কাজ করতে গিয়ে আহত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ৬৭ শতাংশ আহত হয় কাটাছেঁড়া ও আঘাতে। এ ছাড়া ভারী জিনিস বহন করতে গিয়ে ঘাড়, পিঠ ও কোমরে ব্যথা পাওয়া এবং হাড় ভেঙে যাওয়া, দগ্ধ হওয়া ও মারধরের শিকার হয় শিশুরা। দেশের ৮টি বিভাগের ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৭ হাজার ২০০ কর্মজীবী শিশু এ জরিপে অংশ নেয়।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে কর্মস্থলে সহিংসতার কারণে শ্রমে নিয়োজিত ২০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
শিশুশ্রমের আওতায় ১৭ লাখ ৭৬ হাজার
এদিকে বিবিএস প্রকাশিত ‘জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২’–এর প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে এখন শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭। এর আগের জরিপের (২০১৩) তুলনায় এ হার প্রায় ৩ শতাংশ বেশি। এই শিশুদের মধ্যে ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন পড়েছে শিশুশ্রমের আওতায়। অন্যদের কাজ অনুমোদনযোগ্য। শিশুশ্রমের আওতায় পড়া শিশুদের ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২১২ জন ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত।
জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০ অনুসারে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োগ করা যাবে না। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে, তাদের এই শ্রমকে অনুমোদনযোগ্য হিসেবে ধরা হয়। তবে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী কোনো শিশু যদি ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে সেটা শিশুশ্রম হবে। আর ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম।
আহত হলেও সুরক্ষা নেই
সাগর মিয়া জানান, তাঁর তিন সন্তানের মধ্যে সোহাগ বড়। ১০ বছর বয়সে কারখানায় কাজ শুরু করে সে। এর আগে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছিলেন। পড়াশোনা করত না। সমবয়সী অন্য শিশুদের সঙ্গে ‘ড্যান্ডি’ নেশায় আসক্ত হতে পারে—এ ভয়ে সোহাগকে কাজে লাগিয়ে দেন। সোহাগের বেতন ১৫ হাজার টাকা। অভাবের সংসারে ছেলের আয় তাঁর জন্য অনেক বড় সহায়তা।
ইব্রাহিমের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায়। আবু তাহের ও সুফিয়া বেগম দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে ইব্রাহিম ছোট। সংসারে অভাবের কারণে অল্প বয়সে কাজে ঢুকেছিলেন তিনি। গত সোমবার ইব্রাহিম প্রথম আলোকে জানান, হুইলচেয়ার ছাড়া তিনি চলতে পারেন না। শরীর অসাড় হয়ে যাওয়ায় প্রায়ই পিঠ, কোমর ও পায়ে ঘা হয়।
জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০ অনুসারে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োগ করা যাবে না। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে, তাদের এই শ্রমকে অনুমোদনযোগ্য হিসেবে ধরা হয়। তবে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী কোনো শিশু যদি ঝুঁকিহীন কাজও করে, তবে সেটা শিশুশ্রম হবে। আর ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কেউ যদি সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ করে, সেটি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম।
শিশু সুরক্ষায় কাজ করা ব্যক্তিদের মতে, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শ্রমিকদের অর্থ সহায়তা দেওয়া হলেও শিশুশ্রম আইনবিরুদ্ধ হওয়ায় শিশুদের এ সুবিধা পাওয়া কঠিন। সমাজসেবা অধিদপ্তরে কর্মজীবী শিশু হিসেবে নয়, দুস্থ শিশু হিসেবে অনুদান পাওয়ার সুযোগ আছে। তবে এসব নিয়ে প্রচার কম থাকায় অনেক অভিভাবক জানেন না।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (নারী ও শিশুশ্রম) মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে দেশে এখনো শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না। শিশুশ্রম প্রতিরোধ, শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের মূলধারায় নিয়ে আসা, কারিগরি শিক্ষা ও আর্থিক সুবিধা দেওয়ার জন্য আড়াই হাজার কোটি টাকার নতুন প্রকল্প নিয়েছে সরকার। শিশুশ্রম বন্ধে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদের মাধ্যমে নজরদারি রাখা হয়। তবে আহত শিশুদের সহায়তায় আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই বলে জানান তিনি।
শিক্ষা ও সুরক্ষায় বিনিয়োগ জরুরি
সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশু সুরক্ষা খাতের পরিচালক আবদুল্লা আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারের শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য রয়েছে। অথচ ২০২৩ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা আরও বেড়েছে। বড়দের কাজ ছোটদের দিয়ে করানো হচ্ছে বলে শিশুরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে সহজে।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, কর্মজীবী শিশুদের নিয়ে শিশুশ্রম নিরসনে প্রকল্প নেওয়ার চেয়ে এখন নজর দেওয়া উচিত শিশুটি যেন শ্রমে না আসে, সেদিকে। শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। স্কুলে পড়াতে হবে, বাল্যবিবাহ ও শ্রমে দেওয়া যাবে না—এই শর্তে সন্তানদের জন্য অভিভাবকদের মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাতা দিলে শিশুশ্রম কমবে। শিশুশ্রম বন্ধে অভিভাবক, নিয়োগকর্তা ও শিশুদের কাছ থেকে সেবা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়ানো দরকার।