সন্তানসম্ভবা সুমাইয়া আক্তার (২২) ভর্তি হয়েছিলেন আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। অবস্থা গুরুতর হওয়ার পর সেখানকার চিকিৎসকেরা তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আজ রোববার বেলা দুইটায় হাসপাতালে এসে তিনি ভর্তি হতে পারেননি।
বেলা তিনটায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে কথা হয় সুমাইয়া আক্তারের স্বামী মো. আরমানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৩ সেপ্টেম্বর প্রসব হওয়ার কথা বলেছিলেন চিকিৎসকেরা। পরে আজ সকালে তাঁর স্ত্রীর প্রসববেদনা ওঠে। আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচার করার পরামর্শ দিয়ে চট্টগ্রামে পাঠান।
পেশায় রাজমিস্ত্রি আরমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে এসে দেখি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তালা ঝুলছে। কোনোভাবেই ঢুকতে পারছি না। কোনো চিকিৎসকও নেই। ফলে চিকিৎসা কীভাবে পাব, কোথায় যাব জানি না। এদিকে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন সুমাইয়া।’
হামলাকারীদের গ্রেপ্তার-বিচার, নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করাসহ চার দফা দাবিতে সারা দেশে সব ধরনের চিকিৎসাকেন্দ্রে সেবা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা এই কর্মসূচিকে বলছেন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’। আজ বেলা দুইটার পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্লকের সামনে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও সেবা বন্ধ করে দেন চিকিৎসকেরা। বিকেল পাঁচটার দিকে চিকিৎসাসেবা চালু হয়।
বেলা দুইটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত হাসপাতালে ঘুরে দেখা যায়, জরুরি বিভাগের ফটকে তালা দেওয়া হয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে রোগীরা এসে ভিড় জমান ফটকের সামনে। এ সময় রোগী ও স্বজনেরা উত্তেজিত হয়ে যান। পরে সেখানে এসে হাজির হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মো. রাসেল আহামেদসহ আরও কয়েকজন। একপর্যায়ে তালা ভেঙে রোগীদের ভেতরে ঢোকান স্বজনেরা।
ষাটোর্ধ্ব মো. মোখলেসুর রহমানের পা ফুলে গেছে। ব্যথায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না তিনি। পরে জরুরি বিভাগের সামনে মেঝেতে শুয়ে পড়েন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী আঞ্জুমান বেগম। মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাড়ি মিরসরাইয়ে। ফোড়া ওঠার কারণে দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারছেন না। প্রচণ্ড ব্যথা। দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালে এসে আটকে গেলেন। ভর্তি হতে পারেননি। দুই ঘণ্টা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে অপেক্ষা করে ১৪ রোগীকে পাওয়া যায়। বিভিন্ন এলাকা থেকে তাঁরা এসেছিলেন।
কর্মবিরতির বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক রাজীব পালিত প্রথম আলোকে বলেন, নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রসহ জরুরি বিভাগে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে দুই ঘণ্টার সভায় আলোচনা করা হয়েছে। তাঁরা চিকিৎসকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়নি।
এদিকে চিকিৎসকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বেলা ২টা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ করেছেন চিকিৎসকেরা। মো. মিজানুর রহমান নামের এক চিকিৎসক ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা চিকিৎসকদের নিরাপত্তা চান।
এর আগে গতকাল শনিবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভাঙচুর ও চিকিৎসকদের মারধরের ঘটনা ঘটে। হামলার বিচার ও নিরাপত্তার দাবিতে আজ সকাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেন চিকিৎসকেরা। পরে সব চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনায় বসে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, কিন্তু সেই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। এরপর চিকিৎসকেরা সারা দেশে কর্মবিরতির ডাক দেন। পাশাপাশি চার দফা দাবি তুলে ধরেন।
চার দফা দাবি হলো
১. হাসপাতালের মতো জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে যেসব ব্যক্তি বা কুচক্রী মহল এই ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের গ্রেপ্তার করা। দ্রুত বিচার আইনের মাধ্যমে তাঁদের শাস্তির আওতায় আনা।
২. নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যে অবিলম্বে দেশের সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য পুলিশের (আমর্ড ফোর্স) মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।।
৩. নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে হাসপাতালে রোগীর ভিজিটর (ভিজিটর কার্ডধারী) ছাড়া বহিরাগত কাউকে কোনোভাবেই ভেতরে প্রবেশ করতে না দেওয়া। বিষয়টি স্বাস্থ্য পুলিশের মাধ্যমে নিশ্চিত করা।
৪. হাসপাতালে রোগীর সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো অবহেলা-অসংগতি পরিলক্ষিত হলে, তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ আকারে জানানো। এভাবে শাস্তি নিশ্চিত করা যেতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।