পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে জরুরি বৈঠক, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ পিটার হাসের
রাজধানীর শাহীনবাগের ঘটনা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সেখানে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার কথা উল্লেখ করে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন।
বুধবার সকালে শাহীনবাগে প্রায় এক দশক ধরে নিখোঁজ বিএনপির নেতা সাজেদুল ইসলামের বাসায় যান পিটার হাস। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় বাসার বাইরে একদল লোক তাঁকে ঘিরে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এ বিষয়ে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র সাংবাদিক জানান, নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকায় বৈঠক শেষ না করেই সাজেদুলদের বাসা থেকে চলে আসেন পিটার হাস। বিষয়টি তাঁরা সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানিয়েছেন।
শাহীনবাগ থেকে আসার পর দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সন্ধ্যায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে একটি অনুষ্ঠানের ফাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান।
আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত জরুরি ভিত্তিতে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বললেন যে তিনি এক বাসায় গিয়েছিলেন, আর সেখানে যখন গিয়েছেন, কিন্তু বাইরে বহু লোক ছিল। তারা উনাকে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। উনার সিকিউরিটির লোকেরা উনাকে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। তারা বলেন যে ‘‘ওরা আপনার গাড়ি ব্লক করে দেবে’’। সেই নিরাপত্তা অনিশ্চয়তা থেকে তিনি তখন তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে গেছেন। এবং এতে তিনি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি উনাকে (রাষ্ট্রদূত) বললাম যে আপনার নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব আমাদের। আপনার ওপর বা আপনার লোকের ওপর কেউ আক্রমণ করেছে? উনি বললেন যে, ‘‘না’’। তবে উনি বললেন যে, উনার গাড়িতে হয়ত দাগ লেগেছে। তবে এটা শিওর না। আমি বললাম, আপনার লোকদের নিরাপত্তা আমি দেব। আপনি যদি অধিকতর নিরাপত্তা চান আমরা দেব।’
মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার কথা উল্লেখ করে উদ্বেগ জানিয়েছেন বলে জানান আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘আপনি ওখানে গেছেন এই খবরটা কীভাবে কে প্রকাশ করল, আমরা তো জানি না। আমরা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছু জানি না। আমাদের তো জানাননি। এ তথ্য লিক করল কে? ওইটার উনি উত্তর দিতে পারেননি। তো আমরা এটাই বলেছি, আপনি বরং বের করেন, আপনি ওখানে যাচ্ছেন, এটা কেমন করে প্রচার হলো, আপনার লোকই তো করতে পারে।’
পিটার হাস শাহীনবাগে যে বাসায় গিয়েছিলেন, সেই বাসার সাজেদুল ইসলাম ২০১৩ সাল থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁর পরিবারের দাবি, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে। তাঁর বোন সানজিদা ইসলাম গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সমন্বয়কারী। তিনি জানান, মার্কিন রাষ্ট্রদূত যখন তাঁদের বাসায় যান, তখন বাইরে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ‘মায়ের কান্না’ নামের আরেকটি সংগঠনের কিছু ব্যক্তি। ‘মায়ের কান্না’ ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের ফাঁসি, কারাদণ্ডের শিকার ও চাকরিচ্যুত সদস্য এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন।
সানজিদা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বুধবার সকাল নয়টার কিছু পর তাঁদের বাসায় যান মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রায় আধা ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেন তিনি। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ডেস্কের কর্মকর্তা লিকা জনসন। তিনি বলেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত আসবেন জেনে তেজগাঁও থানার ওসির নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল দুদিন (গত মঙ্গলবার ও গতকাল) আমাদের বাসায় আসেন। রাষ্ট্রদূত বাসায় প্রবেশের প্রায় ৪০ মিনিট আগে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও মায়ের কান্না সংগঠনের লোকজন রাস্তার ওপরে অবস্থান নেন। বাসা থেকে বেরিয়ে যখন পিটার হাস গাড়িতে উঠছিলেন, তখন তাঁরা কথা বলার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে হট্টগোল হয়। পরে তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা থানা-পুলিশের সদস্যদের সহায়তায় তিনি গাড়িতে উঠে চলে যান।’
এ বিষয়ে তেজগাঁও থানার ওসি অপূর্ব হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মায়ের কান্না নামে একটি সংগঠনের লোকজন এসেছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলে স্মারকলিপি দিতে। তিনি ওই বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠেন, কোনো দিকে কর্ণপাত না করে চলে যান। কোনো হট্টগোল হয়নি।’
এ বিষয়ে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে কথোপকথন তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলেছি, যদি কেউ আপনার ওপর আক্রমণ করে, আপনার লোকদের অ্যাসল্ট করে, পাবলিক প্রপার্টি, প্রাইভেট প্রপার্টি ধ্বংস করে, আমি তাঁদের গ্রেপ্তার করব। আপনার প্রটেকশন আমরা দেব।’
তবে বাংলাদেশে গণমাধ্যম খুব সোচ্চার হওয়ায় তাদের আটকাতে পারবেন না বলে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, পিটার হাস চাইলে মিডিয়াকে তিনি ১০ ফুট, ১৫ ফুট দূরে রাখতে পারবেন।
দেশে সবার কথা বলার অধিকার থাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের অবস্থানের সময় সাজেদুলের বাসার বাইরে যেসব লোক সমবেত হয়েছিলেন, তাঁদেরকেও বাধা দিতে পারবেন না বলে বৈঠকে উল্লেখ করেছেন আব্দুল মোমেন। বৈঠকের আলোচনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ওখানে লোকজন গেছে সেখানে বাধা দিতে পারব না। আপনার (পিটার হাস) প্রটোকশনের জন্য দূরে রাখব। তারা তাদের বক্তব্য দেবে, আমি তাদের গ্রেপ্তার করতে পারব না। আপনার ওপর বা আপনার লোকের ওপর যদি আক্রমণ হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয় পাবলিক ও প্রাইভেট প্রপার্টি ধ্বংস করে তাদের গ্রেপ্তার করতে পারি।’