বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে ‘সংসার খরচ আরও বাড়বে’
১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও ভোক্তা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হলো দাম।
ভোক্তা পর্যায়ে মাসে মাসে বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। এবার বাড়ল আরও ৫ শতাংশ। এতে তিন মাস ধরে প্রতি মাসের বিদ্যুৎ বিলে যুক্ত হচ্ছে নতুন খরচ। শুধু তা–ই নয়, বাজার চড়ে থাকা নিত্যপণ্যের দামও বাড়ছে। এখন বাড়বে আরও। সব মিলিয়ে বাড়তি খরচের চাপ সামলাতে আরও হিমশিম খাবেন ভোক্তারা।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে বলা হয়, বিদ্যুতের নতুন দাম মাস মার্চ থেকে কার্যকর হবে। তবে এবার ভোক্তা পর্যায়ে বাড়ানো হলেও পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়নি। এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি জারি করা প্রজ্ঞাপনে পাইকারি পর্যায়ে গড়ে ৮ শতাংশ ও ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল বিদ্যুতের দাম।
দেশের প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ কিনে নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এরপর তারা উৎপাদন খরচের চেয়ে কিছুটা কম দামে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে। ঘাটতি মেটাতে পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেয়। তবে বিতরণ সংস্থাগুলো কোনো ভর্তুকি পায় না। তারা নিয়মিত মুনাফা করছে। গত অর্থবছরেও মুনাফা করেছে বিতরণ সংস্থাগুলো। তবে গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে দুই দফায় পাইকারি দাম বাড়ায় ঘাটতি তৈরি হয়েছে তাদের। এবার নিয়ে তিন দফায় মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে তাদের ঘাটতি অনেকটা পূরণ হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিদ্যুতের নতুন মূল্যহার অনুযায়ী, গ্রাহক পর্যায়ে সবচেয়ে কম ব্যবহারকারী শ্রেণিতে প্রতি ইউনিটের দাম ৪ টাকা ১৪ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ টাকা ৩৫ পয়সা। এটি মূলত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য, যাদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ৫০ ইউনিট। বাসাতে একটি বা দুটি লাইট ও ফ্যান ব্যবহার করে যারা। পরের ধাপে ৪ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪ টাকা ৮৫ পয়সা। আর আবাসিক খাতে সর্বোচ্চ ব্যবহারকারী গ্রাহকের ক্ষেত্রে ১২ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৩ টাকা ২৬ পয়সা। কৃষিকাজের সেচে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৫৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪ টাকা ৮২ পয়সা।
এটা কতখানি সমন্বয়, কতটা যৌক্তিক; তা বোঝার কোনো উপায় নেই। নির্বাহী আদেশের পরিবর্তে বিইআরসি দাম বাড়ালে তা জানা যেত।
ক্ষুদ্র শিল্পের গ্রাহকদের জন্য গড় বিদ্যুতের দাম ৯ টাকা ৪১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯ টাকা ৮৮ পয়সা। আর বাণিজ্যিক ও অফিসের জন্য গড় দাম ১১ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১১ টাকা ৯৩ পয়সা। তবে এসব গ্রাহক মূলত নিম্ন চাপের বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। বড় শিল্প–গ্রাহকদের ব্যবহার বেশি। তাই তাদের বাড়তি চাপের বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হয়। মধ্যম চাপের শিল্প–গ্রাহকদের গড় দাম ৯ টাকা ৪৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৭২ পয়সা করা হয়েছে। অর্থাৎ সব ধাপেই গড়ে ৫ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক উৎসাহ দেওয়া হয়। তখন থেকে এ খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। সব মিলিয়ে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট, যদিও এখন পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের নিচে। ফলে সব সময়ই বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাংশকে বসিয়ে ভাড়া দিতে হয়, যা ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ (কেন্দ্র ভাড়া) নামে পরিচিত। বছরে এর পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
পিডিবি সূত্র বলছে, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পিডিবির এখন খরচ হচ্ছে প্রায় ১১ টাকা। এখন তারা এটি পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি করছে ৬ টাকা ৭০ পয়সায়। এতে আয়-ব্যয়ে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে পিডিবির। ফলে চলতি অর্থবছরেও ভর্তুকি বরাদ্দ আছে ১৭ হাজার কোটি টাকা, তবে বছর শেষে তা ৩৫ থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই বিদ্যুতের দাম আরও বাড়াতে হতে পারে।
বিপুল ভর্তুকি কমাতে সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম এখন দফায় দফায় বাড়াচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মাসে মাসে দর সমন্বয় হতে পারে। দাম বাড়াতে এখন আর গণশুনানির প্রয়োজন হচ্ছে না। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। এখন পর্যন্ত গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম।ন
সমন্বয়ের নামে প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এটা কতখানি সমন্বয়, কতটা যৌক্তিক; তা বোঝার কোনো উপায় নেই। নির্বাহী আদেশের পরিবর্তে বিইআরসি দাম বাড়ালে তা জানা যেত। এখন নিত্যপণে৵র দাম বাড়বে, ব্যক্তিগত খরচ আরও বাড়বে। কিন্তু মানুষের আয় তো বাড়বে না।
‘দাম শুধু বাড়ছেই’
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। এই ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, সরকারের ভর্তুকি কমানো। বাংলাদেশ আলোচনা পর্যায় থেকে এই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে মাসে মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। এর আগে গ্যাসের দাম গড়ে ৮২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল গত ১৮ জানুয়ারি। এটিও ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। এখন গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম মিলে শিল্পকারখানায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। যেসব শিল্পে নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র (ক্যাপটিভ) আছে, তাদের হয়তো বাড়তি বিল গুনতে হবে না। তবে এসব শিল্পকারখানার সংখ্যা খুব বেশি নয়। আর সব মিলিয়ে এমন একটি সময়ে সরকার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে, যখন বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপক চড়া।
দেশের বৃহত্তম রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত গতকাল সন্ধ্যায় এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন করে ৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে আমাদের পণ্যের উৎপাদন খরচও নতুন করে বাড়বে। প্রাথমিকভাবে আমরা হিসাব করে দেখেছি, নতুন করে দাম বাড়ানোর কারণে প্রতি টন রড উৎপাদনে বিদ্যুৎ খরচ বাবদ ৪০০ টাকা বাড়তি খরচ হবে। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক খরচও বেড়ে যাবে। টান পড়বে কোম্পানির চলতি মূলধনে।’
তপন সেনগুপ্ত আরও বলেন, বর্তমানে বিশ্ববাজারে রডের কাঁচামালের দাম বেশ ঊর্ধ্বমুখী। ডলার–সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্যের দামেও তার প্রভাব পড়বে। শেষ বিচারে বাড়তি এ দামের বোঝা গিয়ে পড়বে ভোক্তার ওপর।
কেবল রড বা সিমেন্ট নয়, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রভাব পড়বে সব খাতেই। এতে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, বাড়বে মূল্যস্ফীতির হারও। সরকারি হিসাবেই দেশের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ।