সিদ্দিকবাজারের ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ, নেই যন্ত্র, উদ্ধার অভিযান ব্যাহত

মঙ্গলবার বিকেলে গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে সাততলা এই ভবনে বিস্ফোরণ হয়
ছবি: প্রথম আলো

গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে কুইন স্যানিটারি মার্কেটের সাততলা ভবনে বিস্ফোরণের পর গতকাল বুধবার পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান শেষ করতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। গতকাল বুধবার সকাল নয়টা থেকে দ্বিতীয় দিনের উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তাঁরা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের জানান, দুজন বেজমেন্টের ভেতরে আটকে আছেন। এরপর গতকাল বুধবার বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে ভবনটির বেজমেন্টে থেকে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আর রাত আটটার দিকে অন্ধকারের কারণে উদ্ধার অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত করে ফায়ার সার্ভিস।

আরও পড়ুন

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে উদ্ধার অভিযান চালাতে বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শ দিতে হয় উদ্ধারকর্মীদের। গতকাল বুধবার বেলা তিনটা পর্যন্ত তাঁরা কয়েকটি সংস্থার সহযোগিতা চেয়েও পাননি তাঁরা। এ ছাড়া ভবনটির বেজমেন্টে উদ্ধার অভিযান চালাতে প্রয়োজন শোরিং (ঠেক দেওয়ার) নামের বিশেষ যন্ত্রের। যা ফায়ার সার্ভিসের কাছে নেই। তাঁরা রাজউক ও সিটি করপোরেশনের কাছে এ যন্ত্রের জন্য সহযোগিতা চেয়েও পাননি বলে অভিযোগ করেন।

উদ্ধার অভিযানের সঙ্গে যুক্ত ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, বিস্ফোরণে যখন কোনো ভবনের কলাম বা বিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয়। ভবনের ওজন হিসাব করে দেখতে হয়। ভবনের ওজন যদি ১০০ কেজি হয়, সে ক্ষেত্রে উদ্ধার অভিযানের জন্য ১৫০ কেজি ওজন সইতে পারে, এমন শোরিং যন্ত্র ব্যবহার করে উদ্ধার অভিযান চালাতে হয়। কিন্তু যন্ত্র না থাকা ও সমন্বয়হীনতার কারণে সেটি হচ্ছে না। আবার কোনো কোনো সংস্থা ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ফায়ার সার্ভিসকে উদ্ধার অভিযানে নিরুৎসাহিত করছে। তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এতে উদ্ধার অভিযানে বিলম্ব হচ্ছে।

আরও পড়ুন

২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর উদ্ধার অভিযান শেষ করতে দীর্ঘদিন লেগে যায়। তখন উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হয়। সক্ষমতা বাড়ানো হয় ফায়ার সার্ভিসের। কিন্তু রানা প্লাজা ধসের ১০ বছর পরে এসেও ফায়ার সার্ভিস বলছে, একটি শোরিং যন্ত্র না থাকায় তাঁরা উদ্ধারকাজ সঠিকভাবে করতে পারছেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফায়ার সার্ভিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোক বলেন, ‘আমাদের কাছে শোরিং যন্ত্র নেই। আমরা রাজউক ও সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা চেয়েও পায়নি। সেই কারণে উদ্ধার অভিযানে এত দেরি হচ্ছে।’

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘শোরিং যন্ত্র না থাকায় বেজমেন্টে অভিযান চালাতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। বড় অনেক যন্ত্রপাতি রয়েছে, তবে আমাদের ছোট গাড়ি ও যন্ত্রের প্রয়োজন রয়েছে।’

আরও পড়ুন

তবে রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞাসহ সংস্থাটির দায়িত্বশীল কমকর্তারা বিস্ফোরণের শিকার ভবনটি ঘুরে দেখেছেন। মঙ্গলবার রাতে ও গতকাল বুধবার সকাল থেকেই ঘটনাস্থলে ছিলেন রাজউকের কর্মকর্তারা। ফায়ার সার্ভিসকে সহযেগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের অথরাইজড অফিসার রংগন মণ্ডল (অঞ্চল ৫ /১) প্রথম আলোকে বলেন, ভবন নির্মাণের অনুমোদনসংক্রান্ত বিষয় দেখভাল করে রাজউক। ঝুঁকিপূর্ণ কোনো ভবন ‘শোরিং’ করার মতো যন্ত্রপাতি সংস্থাটির নেই। আইন অনুযায়ী কোনো ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হলে সেটি ঝুঁকিমুক্ত করা বা অপসারণ করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। সিটি করপোরেশনের এ ধরনের যন্ত্রপাতি থাকতে পারে।

এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বলেন, ‘আমরা ফায়ার সার্ভিসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে একটি হুইল এক্সকাভেটর দুর্ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছি। এ ছাড়া উদ্ধারকাজে আরও কোনো ধরনের যান বা যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হলে তা দ্রুততার সঙ্গে সরবরাহ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

রাজউকের পরিদর্শন

ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির ঝুঁকি বিবেচনায় ব্যবহার উপযোগিতার বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নে রাজউকের গঠিত কার্যকরী কমিটির সদস্যরা গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তাঁরা বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত দুটি ভবনেই নিচ থেকে ছাদ পর্যন্ত, যেখানে যেখানে যাওয়া সম্ভব, সেখানে যান এবং ভবন পরিদর্শন করেন।

পরিদর্শন শেষে কমিটির আহ্বায়ক রাজউকের সদস্য উন্নয়ন মেজর (অব) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী বলেন, আন্ডারগ্রাউন্ডে কলাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কলামগুলোকে সাপোর্ট দিতে হবে। ভবনে ২৪টি কলাম আছে, এর মধে৵ ৯টি কলাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যান্য কলামেও প্রভাবে পড়েছে। এখন এই কলামগুলোকে স্থিতিশীল করতে হবে। সাপোর্টিং লোড হিসেবে অন্য কোনো বিম বা বাম্পারের মাধ্যমে সাপোর্ট দিতে হবে। দ্রুত বিষয়টি নিয়ে কাজ করা হবে।

এ অবস্থায় উদ্ধার কার্যক্রমের কী হবে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য, বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক রাকিব আহসান বলেন, কলাম ধসে না পড়লেও কোনো কোনো কলামের নিচে ও ওপরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই অবস্থায় কাজ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এখন কলামগুলোকে স্থিতিশীল না করে কাজ করা যাবে না। এ ছাড়া ভবনটি অনেক পুরোনো। তখন ভবন নির্মাণের মান অনুসরণ করা হয়েছিল কি না, সেটিও দেখার বিষয়।

কমিটির আরেক সদস্য বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমদ আনসারী প্রথম আলোকে বলেন, বেসমেন্টে আসল ক্ষতি হয়েছে। ভবনটির ভিত্তিতে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, এগুলো যাচাই করতে হবে। এসব যাচাই করতে মাস দুয়েক সময় লাগবে। তিনি আরও বলেন, ১৯৮০ সালে ভবনটি তিনতলা করা হয়েছিল। তাই এখন মাটি পরীক্ষা করতে হবে। নতুন কোনো সমস্য তৈরি হলো কি না, যাচাই করতে হবে। ভবনটি বাসযোগ্য করতে এক বছরের মতো সময় লাগবে। আপাতত ভবনটি ব্যবহার করা যাবে না। ক্ষতিগ্রস্ত কলামগুলোকে দ্রুত সাপোর্ট দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে, যাতে ভবনটি ধসে না যায়।

ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার তৎপরতা

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিস্ফোরণের পর আশপাশের লোকজন গিয়ে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন। ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর সূত্র জানায়, বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে বিস্ফোরণের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট। তারা উদ্ধারকাজ শুরু করে। পরে আরও ছয়টি ইউনিট যোগ দেয়। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দীনমণি শর্মা প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিচতলায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এখন পর্যন্ত চারজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। আমরা ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে লোকজনকে খুঁজছি।’

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, মঙ্গলবার রাত ৯টা ১৫ পর্যন্ত ১৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ৪০ জনকে। পরে রাত পৌনে ১১টার দিকে উদ্ধারকাজ স্থগিত করা হয়। তখন ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় ভবনের ভূগর্ভস্থ স্থানে উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব নয়। সকালে সেনাবাহিনী আসবে, তারপর উদ্ধারকাজ শুরু হবে।

গতকাল নয়টার দিকে ঘটনাস্থলে প্রবেশ করেন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা। কিন্তু বেলা ১১টা পর্যন্ত ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি না পাওয়ায় ভবনের ভেতরে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করতে পারছিলেন না তাঁরা। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মৌখিকভাবে কথা বলে বেলা তিনটার দিকে অভিযান শুরু করেন। প্রায় দুই ঘণ্টার উদ্ধার অভিযান শেষে দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

ফায়ার সার্ভিস ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক আক্তারুজ্জামান বলেন, বেজমেন্টে মাছি দেখে মরদেহ শনাক্ত করা হয়। পরে র‍্যাবের ডগ স্কোয়াড দিয়ে তল্লাশি করে নিশ্চিত হওয়ার পর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।