৫–২০ আগস্ট: হামলার শিকার সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০৬৮

দেশে গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হিন্দু সম্প্রদায়সহ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। আবার এসব হামলাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ভারতীয় মূলধারার কিছু গণমাধ্যমে অনেক অপতথ্যও ছড়ানো হয়েছে। বহু মৃত্যুর সংখ্যা বলা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে প্রথম আলোতে শুরু থেকেই বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তা ছিল ঘটনাভিত্তিক, সার্বিক চিত্র নয়। এ কারণে দেশব্যাপী অনুসন্ধান করে সঠিক তথ্য জানা প্রয়োজন। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার তথ্য সংগ্রহ করা হয় ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত। সংগৃহীত তথ্য পুনরায় যাচাই, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন প্রস্তুতের মধ্যে বিভিন্ন জেলায় শুরু হয় বন্যা। তবে এখনো দেশে ও বিদেশে এসব নিয়ে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিলম্ব হলেও বিভিন্ন জেলায় সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রতিক হামলার একটি চিত্র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৯টিতে হামলার ঘটনা ঘটার তথ্য পাওয়া যায়। নিহত ২ জন। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বহু হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও বাড়িঘরে, কোথাও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে, কোথাও উপাসনালয়ে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।

হামলা শুরু হয় মূলত গত ৫ আগস্ট বিকেল থেকে। প্রথম দুই দিন হামলার ঘটনা বেশি ঘটে। সারা দেশে প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত অনুসন্ধান চালিয়ে হামলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তত ১ হাজার ৬৮টি ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য পেয়েছেন। এর বাইরে হামলা হয়েছে ২২টি উপাসনালয়ে।

সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগে। বিভাগটিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তত ২৯৫টি বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা হয়। রংপুর বিভাগে ২১৯টি, ময়মনসিংহে ১৮৩টি, রাজশাহীতে ১৫৫টি, ঢাকায় ৭৮টি, বরিশালে ৬৮টি, চট্টগ্রামে ৪৫টি এবং সিলেটে ২৫টি বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। কোথাও কোথাও স্থাপনা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কোথাও কোথাও কম।

নিহত ২

সরকার পতনের পর হামলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। একজন মৃণাল কান্তি চ্যাটার্জি। বাগেরহাটের এই অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষককে গত ৫ আগস্ট রাতে মারধর ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আরেকজন খুলনার পাইকগাছা ইউনিয়নের স্বপন কুমার বিশ্বাস। ৮ আগস্ট বাড়ি ফেরার পথে তাঁকে মারধর ও নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। 

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রাথমিক হিসাব (২০ আগস্ট দেওয়া) অনুযায়ী, ৫০টির বেশি জেলায় দুই শতাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত মঙ্গলবার তারা জানায়, বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের পর তারা একটি প্রতিবেদন তৈরি করছে। শিগগিরই সংবাদ সম্মেলনে সেটি তুলে ধরা হবে। 

নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের কারণে কোনো ভেদাভেদ করা হবে না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত গত মাসে প্রথম আলোকে বলেন, ৫০ বছর ধরে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, সরকারবিরোধী আন্দোলন ও নানা পটভূমিতে সংখ্যালঘুদের টার্গেট (লক্ষ্যবস্তু) করে হামলার ঘটনা ঘটে আসছে। এসব হামলার মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে সংখ্যালঘুশূন্য করা। 

এর আগে সংখ্যালঘুদের ওপর বড় হামলা হয় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২১ সালে দুর্গাপূজার সময়। তখন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ বলেছিল, ওই বছর ১৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ২৭টি জেলায় হামলায় ১১৭টি মন্দির-পূজামণ্ডপ ভাঙচুর করা হয়। ৩০১টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি হামলা-লুটপাটের শিকার হয়। নিহত হন ৯ জন।

এবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যে ১ হাজার ৬৮টি স্থাপনায় হামলা হয়েছে, তার অন্তত ৫০৬টির মালিক আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

সারা দেশে প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা (৬৪ জেলা ও ৬৭টি উপজেলা) অনুসন্ধান চালিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার তথ্য পেয়েছেন মোট ৪৯ জেলায়। তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫৪৬টি সরেজমিনে দেখেছেন, যা মোট ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনার ৫১ শতাংশ। বাকিগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়েছেন। বেশ কিছু জেলায় হামলা হয়েছে ব্যাপকভাবে। কিছু জেলায় সে তুলনায় কম। অন্তত একটি ঘটনা ঘটেছে, এমন হিসাবে হামলা হওয়া জেলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯। 

হিন্দুধর্মাবলম্বী ছাড়া হামলা হয়েছে খ্রিষ্টান ও আহমদিয়া সম্প্রদায় এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর। বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, নওগাঁয় চার্চ অব বাংলাদেশ, দিনাজপুরে ইভ্যানজিলিক্যা হলিনেস চার্চ, নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে দি খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়নের কালেকশন বুথ এবং বরিশালের গৌরনদীতে তিনটি, খুলনা শহরে একটি, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে একটি ও পার্বতীপুরে একটি খ্রিষ্টান বাড়িতে হামলা হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ে নিজপাড়া মিশনে মা মারিয়ার মূর্তি ভাঙা হয়েছে।

ঢাকায় রোমান ক্যাথলিক চার্চের আর্চবিশপ বিজয় নিসফরাস ডি’ক্রুজ বলেন, ‘আমরা এ দেশে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে শান্তিতে বসবাস করতে চাই। কিন্তু নানা সময় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়। কিন্তু হামলাকারীদের শাস্তি হয় না।’ তিনি বলেন, শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে হামলা বন্ধ হবে না। 

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দিনাজপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর অন্তত ১০টি হামলায় অন্তত ১৮টি ঘরবাড়ি ভাঙচুর অথবা অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। জমি দখল ও মাছ লুটের দুটি ঘটনা ঘটেছে। দিনাজপুরে সাঁওতাল বিদ্রোহের ঐতিহাসিক দুই চরিত্র সিধু মুর্মু ও কানু মুর্মুর ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়েছে।

আহমদিয়া সম্প্রদায় জানিয়েছে, পঞ্চগড়, রংপুর, রাজশাহী, নীলফামারী, ঢাকার মাদারটেক, শেরপুর ও ময়মনসিংহে হামলায় তাঁদের ১৩৭টি বাড়িঘর ও ৬টি আহমদিয়া মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আহমদিয়া মুসলিম জামাতের জনসংযোগ সম্পাদক আহমাদ তাবশির চৌধুরী বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করি না, কোনো দলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। আমার মনে হয়, আমাদের ওপর এবারের আক্রমণ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় না থাকার সুযোগে।’ তিনি বলেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আমলেও আহমদিয়াদের ওপর হামলা হয়েছিল।

হামলার শিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হামলা হয় সরকার পতনের পর ‘বিজয় মিছিল’ থেকে। হামলাকারীদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াত এবং কিছু ধর্মীয় সংগঠনের স্থানীয় উগ্র কর্মী ও সমর্থকেরা ছিলেন। তবে ৬ আগস্ট থেকে বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি, জামায়াত, বিভিন্ন ধর্মীও সংগঠন এবং শিক্ষার্থী ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে সংখ্যালঘুদের স্থাপনায় পাহারার ব্যবস্থাও করা হয়। হামলার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে বক্তব্যও দিয়েছে। 

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। ১৩ আগস্ট বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের ৪০ জন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন ড. ইউনূস। ওই দিন তিনি ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শনেও যান। সেখানে তিনি বলেন, ‘এমন বাংলাদেশ আমরা গড়তে চাচ্ছি, যেটা একটা পরিবার, এটাই হচ্ছে মূল জিনিস। এই পরিবারের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা, বিভেদ করার প্রশ্নই আসে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশি।’

বেশি হামলা খুলনা বিভাগে

খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বেশি হামলা হয়েছে। প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের অনুসন্ধানে উঠে আসে, বিভাগটির ১০টি জেলার সব কটিতেই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে খুলনা জেলায় সবচেয়ে বেশি (৭৪টি) ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা হয়। এরপর যশোর, সাতক্ষীরা ও মাগুরার সংখ্যালঘুরা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। 

খুলনায় হামলার আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে পালান। যেমন জেলার কয়রা উপজেলার সুজিত রায় বলেন, ৫ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে হামলা করতে আসছে শুনে তাঁরা বাড়ির সবাইকে নিয়ে আরেক বাড়িতে চলে যান। যেতে যেতেই শুনতে পান তাঁরা ভাঙচুরের শব্দ। তিনি বলেন, ঘরের চাল থেকে শুরু করে আসবাব—সব ভেঙেচুরে দিয়েছে।

যশোর শহরের বেজপাড়ায় ৫ আগস্ট রাতে হামলা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই দিন রাত সোয়া ৯টার দিকে ২০-২৫ জন লোক রামদা, লাঠিসোঁটা নিয়ে সেখানে হামলা করে। তারা ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে এবং লুটপাট চালায়।

বেজপাড়ার বনানী সড়কে পরেশ বসুর বাড়ির নিচতলায় ভাড়া থাকেন লক্ষ্মী রানী পাল। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, হামলাকারীরা লক্ষ্মী রানীর সেলাই মেশিন, রান্নার চুলা, গ্যাসের সিলিন্ডার ও আলমারিতে রাখা তাঁর ভাইয়ের সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর গয়না লুট করে নিয়ে যায়। বাড়ির মালিক পরেশ বসুর স্ত্রী লক্ষ্মী বসু প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার পর লক্ষ্মী রানী পাল ও তাঁর পরিবারের লোকেরা অন্যত্র চলে গেছেন। 

রংপুর, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী বিভাগ

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হামলা হয়েছে রংপুর বিভাগে। এ বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন বেশি হামলার শিকার হন। 

ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের ৭৮টি বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ১৯ থেকে ২১ আগস্ট ঠাকুরগাঁও সদর ও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা ঘুরে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেন প্রথম আলোর প্রতিনিধি। সদর উপজেলার শুকানপুকুরী ইউনিয়নের লাউথুতি গ্রামের কমল বর্মণ প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ করেই লোকজন লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। তারা ঘরে যা পেয়েছে, তা লুট করে নিয়ে গেছে। 

ময়মনসিংহ বিভাগে হামলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে ক্ষতির সংখ্যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। বেশির ভাগ হামলা হয়েছে বিভাগটির নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলায়। শেরপুর ও জামালপুরে হামলা তুলনামূলক কম। 

নেত্রকোনা শহরে গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার, দুর্গা মিষ্টান্ন ভান্ডার, উত্তরা হোটেলসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ১৯টি দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। ২৩ আগস্ট সরেজমিনে দেখে ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দোকানগুলো চালু হয়েছে। তার আগে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সহযোগিতায় খোয়া যাওয়া রেফ্রিজারেটর, আসবাবসহ কিছু মালামাল ফেরতও পাওয়া গেছে। উত্তরা হোটেলের মালিক দেবশঙ্কর রায় প্রথম আলোকে বলেন, আর কোনো হামলা হবে না বলে আশ্বাস পেয়ে তাঁরা দুই দিন পর দোকান খোলেন।

রাজশাহী বিভাগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যে হামলা হয়েছে, তা চতুর্থ সর্বোচ্চ। বিভাগটির মধ্যে বেশি হামলা হয়েছে রাজশাহী, বগুড়া ও নওগাঁ জেলায়। রাজশাহীতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ওপরও হামলা হয়। ৫ আগস্ট জেলার মোহনপুর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের পল্লিতে হামলার ঘটনা ঘটে। ১৭ আগস্ট প্রথম আলোর প্রতিনিধি দেখেছেন, অনেকের ঘরের চালা ভেঙে ফেলা হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে তিনটি বাড়িতে। একটি মন্দিরও ভাঙা হয়েছে। 

পল্লিটির বাসিন্দা সূর্যি রানী চোখ মুছতে মুছতে প্রথম আলোকে বলেন, হামলা থেকে বাঁচতে তিনি, তাঁর মেয়ে ও স্বামী নদে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। 

ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট বিভাগ

ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেটে হামলা অন্য বিভাগগুলোর তুলনায় কম। ঢাকা বিভাগের মধ্যে নরসিংদী, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও টাঙ্গাইলে; বরিশালের মধ্যে বরগুনা ও পিরোজপুর; চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও খাগড়াছড়ি এবং সিলেট বিভাগে মৌলভীবাজার ও সিলেটে হামলার ঘটনা বেশি। 

ঢাকা বিভাগের শরীয়তপুর জেলা শহরের ধানুকা মনসা বাড়ির একটি মন্দির ৫ আগস্ট ভেঙে দেওয়া হয়। দুই থেকে তিন ঘণ্টা ভাঙচুর চলে। ধানুকা মনসা বাড়ি মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দ চক্রবর্তী ৬ আগস্ট প্রথম আলোকে বলেন, ‘হামলাকারীরা আমাদের বাড়ি ভাঙচুরের জন্য চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল। সেনাসদস্যরা আমাদের উদ্ধার করেছেন।’

‘সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে’

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা বলছেন, যেসব জায়গায় হামলা হয়নি, সেখানেও মানুষ ব্যাপক আতঙ্কে ছিলেন। আতঙ্ক পুরোপুরি কাটেনি। 

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সুযোগ পেলে বাংলাদেশে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলে, তাঁদের সম্পদ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়। এবার একটি ইতিবাচক দিকও দেখা গেছে। সেটা হলো, অনেকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে এগিয়ে গেছেন। এই ইতিবাচক দিকটিকে উৎসাহিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের কারণে কোনো ভেদাভেদ করা হবে না।’

[প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলার প্রথম আলোপ্রতিবেদক প্রতিনিধিরা]