আশপাশের দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে ভ্রমণ ব্যয়বহুল

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে সুগন্ধা পয়েন্টে পর্যটকদের ভিড়। গতকাল দুপুরেছবি: প্রথম আলো

বিশ্বের জনপ্রিয় পর্যটন–গন্তব্যের তালিকায় নেই বাংলাদেশের নাম। এ দেশে বিদেশি পর্যটকও আসেন হাতে গোনা। মূলত দেশের পর্যটন খাত নির্ভর করে স্থানীয় পর্যটকদের ওপর। তবু আশপাশের বিভিন্ন দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ভ্রমণ বেশ ব্যয়বহুল।

প্রতিবেশী দেশগুলোয় অনায়াসে ঘুরে বেড়ানো যায় বাংলাদেশের চেয়ে কম খরচে। এ কারণে গত কয়েক বছরে ভারতে বেড়ানোর প্রবণতা অনেক বেড়েছে।

প্রতিবছর গড়ে এক কোটির মতো পর্যটক দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই নিজেদের মতো করে ভ্রমণপরিকল্পনা করেন। তবে একটি অংশ বেড়াতে যায় বিভিন্ন ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে।

আরও পড়ুন

নিয়মিত পর্যটক ও ট্যুর অপারেটরা বলছেন, অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে হোটেল-রিসোর্টের ভাড়া বেশি। পরিবহন খরচ চড়া। খাবারের দামও অনেক বেশি।

গত এক দশকে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপ ছাড়া বাকি সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ভ্রমণের খরচ অনেক বেশি। ওই সব দেশের তুলনায় একই মানের হোটেল বা রিসোর্টের ভাড়া দেশে প্রায় দ্বিগুণ। উড়োজাহাজ, বাস কিংবা বেড়ানোর জন্য গাড়ির ভাড়াও অনেক বেশি দেশে। এ ছাড়া অন্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি দাম রাখা হয় দেশের রেস্তোরাঁয়।

বাংলাদেশে বাড়তি ভ্রমণ খরচের জন্য এই খাতের ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার মানসিকতাকে দায়ী করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলেন, এখানে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসার চিন্তা নেই। দ্রুত মুনাফা করার প্রবণতা কাজ করে। দেশে পর্যটনবান্ধব নীতি গড়ে ওঠেনি। এ কারণে ঈদ বা যেকোনো বড় উৎসবে ছুটির সময় ভ্রমণ খরচ আরও বেড়ে যায়। চাহিদার তুলনায় ঘাটতি দেখা দিলেই এ পরিস্থিতির সুযোগ নেন হোটেল-রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা।

আরও পড়ুন

হোটেল মালিকেরা বলছেন, বাংলাদেশে জমির দাম ও অবকাঠামো নির্মাণ খরচ বেশি। তাই বিনিয়োগ তুলে আনার হিসাব করেই ভাড়া নির্ধারণ করতে হয়। এ ছাড়া এখানকার আবহাওয়া সারা বছরের জন্য পর্যটনের উপযোগী নয়। মূলত শীতের মৌসুমে কয়েক মাস পর্যটকদের ভিড় থাকে। বছরের বাকি সময় অধিকাংশ এলাকার হোটেল-রিসোর্ট ব্যবসায়িকভাবে লোকসানে থাকে।

তবে হোটেলমালিকদের এই দাবি পুরোপুরি সত্য নয়। দেশের পর্যটন–গন্তব্যের জনপ্রিয় স্থানগুলোয় এখন সারা বছরই পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। একসময় পর্যটকেরা শুধু শীতে বেড়াতে গেলেও এখন বছরের বিভিন্ন সময় তাঁরা কক্সবাজার, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি ভিড় করেন।

আরও পড়ুন

হোটেল-রিসোর্টের চড়া ভাড়া

২০২১ সালের ডিসেম্বরে ভারতের কেরালা রাজ্যের সমুদ্রশহর কোচির একটি পাঁচ তারকা রিসোর্টে এক কক্ষে এক রাতের ভাড়া দিতে হয়েছিল ৬ হাজার রুপি। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা এখন ৮ হাজার ৪০০ টাকা। একই রিসোর্ট কোম্পানি এখন কক্সবাজারে একটি চার তারকা হোটেল পরিচালনা করছে। এখানে তারা একটি কক্ষের সর্বনিম্ন ভাড়া রাখছে ১৬ হাজার টাকা।

ভারতের নানান জনপ্রিয় পর্যটন–গন্তব্যে বিভিন্ন মানের হোটেল-রিসোর্ট আছে। সেখানকার তিন তারকা মানের হোটেলের প্রতিটি কক্ষ গড়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার সমমানে পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন

ভুটান, নেপাল ও থাইল্যান্ডেও সমমানের হোটেলের ভাড়া প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু দেশের মধ্যে কোথাও এমন ভাড়ায় একই মানের হোটেলকক্ষ পাওয়া যায় না। শ্রীমঙ্গলে একই মানের হোটেল-রিসোর্টের কক্ষের ভাড়া শুরু হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকায়। কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের হোটেলগুলোতেও একই অবস্থা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জমির দামের কারণেই হোটেল-রিসোর্ট করতে বিনিয়োগ বেড়ে যায়। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয় চড়া সুদে। অবকাঠামো গড়ে তুলতে অধিকাংশ পণ্য আমদানি করতে হয় পদে পদে শুল্ক দিয়ে। প্রতিবেশী দেশগুলোর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আলাদা। তাই তারা কম খরচে হোটেল-রিসোর্ট পরিচালনা করতে পারে। এ ছাড়া পর্যটন বিকাশে রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ দেশে নেই। ২৭টি মন্ত্রণালয় কোনো না কোনোভাবে পর্যটন খাতের সঙ্গ যুক্ত। কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে পর্যটন নিয়ে কোনো সমন্বয় নেই।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের প্রথম আলোকে বলেন, অবকাঠামো বাবদ খরচ অবশ্যই বেশি। তবে ব্যয়বহুল পর্যটনের পেছনে মূলত দায়ী ব্যবসায়ীদের মানসিকতা। নিয়মিত পর্যটক ধরে রাখার চেয়ে একবারে বাড়তি আয়ের চিন্তা কাজ করে তাঁদের মধ্যে। সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি পর্যটনবান্ধব নয়। এই খাতের ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিয়মিত উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

উড়োজাহাজ থেকে গাড়ি—সবখানে ভাড়া বেশি

হোটেল-রেস্তোরাঁর পর পর্যটন খাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবহন খরচ। বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব), অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্সিজ অব বাংলাদেশ (আটাব), প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ, ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, কক্সবাজার হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস মালিক সমিতি, একাধিক ট্রাভেল এজেন্ট ও পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানুষের বেড়াতে যাওয়ার আগ্রহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পর্যটন খাতে পরিবহন খরচও বেড়েছে।

পর্যটন খাতের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে উড়োজাহাজের টিকিটের দাম বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ থেকে বাইরের বিভিন্ন গন্তব্যে তা বেড়ে কয়েক গুণ হয়েছে। ঈদের সময় টিকিটের দাম আরও বেড়ে যায়।

দেশের মধ্যে উড়োজাহাজে ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের ফ্লাইটে যেতে খরচ হয় ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা। আশপাশের দেশগুলোয় একই দূরত্বে ২ থেকে ৩ হাজার টাকার সমমানে টিকিট পাওয়া যায়। ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে যেতেও উড়োজাহাজের টিকিটের দাম দ্বিগুণের বেশি। অথচ কলকাতা থেকে একই দূরত্বের ফ্লাইটের টিকিট পাওয়া যায় অর্ধেক দামে।

শুধু ফ্লাইট নয়, বাসের ভাড়াও দেশে বেশি। দেশে ২০০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার যাতায়াতে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) বাসের টিকিটের দাম পড়ে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। একই দূরত্বে একই মানের বাসে অন্য দেশে টিকিট পাওয়া যায় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা সমমানে।

আরও পড়ুন

গত ডিসেম্বরে ভুটান বেড়ানোর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দেশটির মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর জন্য এসি ট্যাক্সি পাওয়া যায় দিনে আড়াই থেকে তিন হাজার রুপিতে। গাড়ির ধরন অনুযায়ী, ভাড়া সর্বোচ্চ ৫ হাজার রুপি। এ গাড়ি নিয়ে এক শহর থেকে আরেক শহর যাওয়া যায়। যত কিলোমিটার যাক না কেন, আর কোনো খরচ যুক্ত হবে না। সব খরচ প্যাকেজের মধ্যেই থাকে। তার মানে, একটি গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দিনে খরচ হতে পারে বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার ২০০ টাকা। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও একই খরচে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়।

আর বাংলাদেশে এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে একই রকমের একটি গাড়ির ভাড়া দিনে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। এমনকি দেশের পর্যটন এলাকার রিকশাভাড়াও বেশি অন্য এলাকার চেয়ে।

আটাবের সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ঠিক, আমাদের বিমানবন্দরে বিভিন্ন সেবার রাষ্ট্রীয় ফি অন্য দেশের তুলনায় বেশি। তবে টিকিটের বাড়তি দামের ক্ষেত্রে অতি মুনাফার মানসিকতা বড় সমস্যা। দেশে প্রতিযোগিতা কম থাকায় ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে এয়ারলাইনসগুলো। সেবার চেয়ে বাড়তি মুনাফার প্রবণতা বেশি। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারি নেই।’

আরও পড়ুন

রেস্তোরাঁয় খাবারের দামও বেশি

শামসুর রহমান ও ফারজানা নীলা দম্পতি সুযোগ পেলে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ান। তাঁরা বলেন, কক্সবাজারের চেয়ে থাইল্যান্ডেও অনেক কম খরচে ভালো মানের খাবার পাওয়া যায়। বেশির ভাগ দেশে পর্যটন এলাকার রাস্তার পাশে গুণগত মানের খাবার পাওয়া যায়। দেশের কোথাও এমনটা পাওয়া যায় না।

ভারতের পর্যটন এলাকায় মোটামুটি ভালো মানের একটি রেস্তোরাঁয় দুপুরে বা রাতের খাবার খেতে একজনের খরচ হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার সমান। নেপালে খরচ এর চেয়েও কম। ভুটানেও একই খরচে খেতে পারেন একজন পর্যটক। অথচ দেশের মধ্যে এই খরচ ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। আর পাঁচ তারকা হোটেলের তুলনায় গেলে দেশে খরচ দ্বিগুণের বেশি।

দীর্ঘদিন ধরে দেশে-বিদেশে ট্যুর পরিচালনা করেন প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ চ্যাপটারের মহাসচিব তৌফিক রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ভ্রমণ খরচ অনেক বেশি। নেপালে ৯০ থেকে ১০০ ডলারে পাঁচ তারকা হোটেলের কক্ষ পাওয়া যায়। দেশে ২০০ ডলারের নিচে কক্ষ নেই। থাইল্যান্ডেও সস্তা। হোটেল-রিসোর্ট, এয়ারলাইনসসহ পর্যটন খাতের সব ব্যবসায়ীর মধ্যে বাণিজ্যিক প্রবণতা বেশি কাজ করে। মূলত এখানে মানসিকতার সমস্যা। এদের কেউ পর্যটনবান্ধব নয়।

আরও পড়ুন