চোখ খুলছে না আয়েশা, টাকার অভাবে আইসিইউতে নিতে পারবে না পরিবার
রাজধানীর ঢাকা শিশু হাসপাতালের প্রথম তলার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ২৭ নম্বর শয্যার রোগী আয়েশা সিদ্দিকা। আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে সে চোখও খুলছে না। পাওয়া যাচ্ছে না রক্তের চাপ। মাত্র ৩ মাস ২০ দিন বয়সী শিশুটি এই ওয়ার্ডের সবচেয়ে কম বয়সী ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। ডেঙ্গু আক্রান্ত সাড়ে ছয় কেজি ওজনের আয়েশাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে গত ৩০ জুলাই। দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে তার শারীরিক অবস্থা। এখন ওকে দ্রুত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আয়েশার বাবা আনসারুল হক বললেন, ‘প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা লাগবে। এই টাকা আমি সামান্য গাড়িচালক কোথায় পাব?’
গত ২৫ জুলাই আয়েশাকে টিকা দেওয়া হয়। এক দিন ভালো ছিল। এরপর শুরু হয় জ্বর। ২৭ জুলাই রক্ত পরীক্ষা করতে দেওয়া হয় ঢাকা শিশু হাসপাতালে। ৩০ জুলাই পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হলে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। কিন্তু আজ সকাল থেকে অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে শিশুটির। ছোট্ট আয়েশার নাড়ির স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে না। রক্তচাপ নেই। দায়িত্বরত চিকিৎসক মেহেনাজ হক প্রথম আলোকে বললেন, ‘শিশুটির শরীরের ভেতর ব্লিডিং (রক্তক্ষরণ) হচ্ছে। শকের প্যারামিটার খুব খারাপ পর্যায়ে। যত দ্রুত সম্ভব ওকে আইসিইউতে নেওয়া দরকার।’
আয়েশার রক্তের অনুচক্রিকা (প্লাটিলেট) নেমে এসেছে ৫৩ হাজারে। আছে ডেঙ্গুজনিত ‘ডি কমপেনসেটেড’ সিনড্রোম, যাকে সহজে বলা হয় ডেঙ্গু শকের একটি গুরুতর পর্যায়।
আজ দুপুরে ঢাকা শিশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, মায়ের মেলে দেওয়া দুই পায়ের ওপর ঘুমাচ্ছে ছোট্ট আয়েশা। চোখে টানা কাজল দিয়েছে মা। কপালের এক পাশে নজর কাটানোর টিপও আছে। ছোট্ট মুঠো হাতের পাশে নীল রঙের কার্টুন আঁকা একটা ফিডার। কিন্তু আয়েশার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। হাসি নেই, কান্নাও নেই।
শিশুটির মা মৌসুমী আক্তার বললেন, ‘গতকাল পর্যন্ত মেয়ের শরীরের অবস্থা তা–ও একরকম ছিল। আজ সকাল থেকে চোখ খুলতেছে না। ডাক্তার আইসিইউর কথা বলছেন। কিন্তু টাকা তো নাই। ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে গত কয়েক দিনে।’
আয়েশার জন্য হাসপাতালে এসেছেন ওর দাদি, নানিসহ আত্মীয়স্বজনেরা। আয়েশার ফুফু তানজিলা আক্তার প্রথম আলোকে জানালেন, তাঁদের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরে। রাজধানীর মহাখালী সাততলা বাজারের কাছে ভাড়া বাসায় থাকেন। আনসারুল হক আর মৌসুমী আক্তারের প্রথম সন্তান আয়েশা। আনসারুল হক বর্তমানে এক ব্যক্তির গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত।
গত এপ্রিলে রাজধানীর আদ্–দ্বীন হাসপাতালে জন্ম হয় এই টুকটুকে শিশুটির। খুব শখ করে নাম রাখা হয় আয়েশা। অসুস্থ আয়েশার শারীরিক অবস্থা জানতে বিকেলে আবার শিশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, অসহায় মা নিরুপায় হয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে তখনো বসে আছেন একইভাবে। স্বজনেরা বিছানা ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছেন। তাঁরা জানালেন, এখন আর ওয়ার্ডের বিছানাতেও তাঁরা থাকতে পারছেন না। এখানেও প্রতিদিন ৭০০ টাকা ভাড়া। বিনা মূল্যের শয্যায় স্থানান্তর করা হচ্ছে আয়েশাকে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে যাওয়ার পরিবর্তে আয়েশা যাচ্ছে বিনা মূল্যের শয্যায়। ফিরে আসার সময় আয়েশার মা বললেন, ‘আমার মেয়েটার জন্য দোয়া করবেন। আমরা খুব অসহায়।’
এমন অসহায় দৃশ্য আরও প্রকট হয়ে উঠল এখানকার আরেক ওয়ার্ডে। ১ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গু আক্রান্ত তুলনামূলক বড় শিশু বেশি। ৪২ নম্বর শয্যায় দেখা গেল অচেতন মেয়ের মুখে লাগানো অক্সিজেন মাস্কের ওপর দিয়ে হাত গলিয়ে আদর করছেন এক মা। ১৩ বছরের সুমাইয়া আক্তারের ডেঙ্গু জ্বর শনাক্ত হয়েছে মাত্র দুই দিন আগে। দ্রুত অবনতি হয়েছে শারীরিক অবস্থার। রক্তে প্লাটিলেট নেমে এসেছে ৩৩ হাজারে।
অচেতন সে। ওর বাবা মো. আনোয়ার শেখ রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি ছোট্ট চায়ের দোকান চালান। সুমাইয়ার মা সুফিয়া আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার সোনা আমার মা...।’
এই ওয়ার্ডে দায়িত্বরত চিকিৎসক শারমিন সুলতানা জানালেন, সুমাইয়ার অবস্থা বেশ খারাপ। ভেতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। তার শরীরে একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। আইসিইউতে নিতে হবে। কিন্তু সেখানে শয্যাসংকট রয়েছে। একজন রোগীর ছাড়া পেলেই আরেকজনকে আইসিইউতে নেওয়া হচ্ছে।
চিকিৎসক যখন সুমাইয়ার পরিস্থিতি জানাচ্ছেন, তখন ওর বাবা আনোয়ার শেখ যাকে সামনে পাচ্ছেন, তার হাত ধরে অনুনয় করছেন, ‘একটু ব্যবস্থা করেন। আমার মেয়েটা মইরা যাবে।’
বেলা দুইটার দিকে এ ঘটনার দুই ঘণ্টা পর আবারও খবর নিতে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সুমাইয়ার বিছানায় অন্য রোগী। হাসপাতাল থেকে জানাল, সুমাইয়াকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়েছেন ওর বাবা।