সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের (সাবেক টুইটার) কিছু পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, কুমিল্লার চান্দিনায় হিন্দুদের দোকানে ইসলামপন্থীরা সংঘবদ্ধভাবে আগুন দিয়েছে। তবে ফ্যাক্টচেক বা তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দাবিটি সঠিক নয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি সত্য হলেও এর সঙ্গে কোনো সাম্প্রদায়িক সংযোগ নেই। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বাজারের অধিকাংশ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে মুসলিম এবং হিন্দু উভয় ধর্মাবলম্বীর ব্যবসায়ীই রয়েছেন।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফারাজ পারভেজ নামের একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া পোস্টের ক্যাপশনে দাবি করা হয়, ‘বাংলাদেশ: কুমিল্লার চান্দিনার মাধাইয়া বাজারে হিন্দুদের দোকানে ইসলামপন্থীদের সংঘবদ্ধ হামলা; লুটপাট এবং অগ্নি সংযোগের দায় স্টোভের শিখার ওপর চাপানো হয়েছে। দয়া করে রিপোস্ট করুন। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিরাপদে নেই।’ এই পোস্টের সঙ্গে যে ভিডিও যুক্ত করা হয় সেখানে একটি বাজার আগুনে পুড়তে দেখা যাচ্ছে। এই ভিডিওটি প্রায় একই দাবিতে একাধিক এক্স অ্যাকাউন্ট (১, ২) থেকে পোস্ট করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের যাচাইয়ে দেখা গেছে, এটি কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া ইউনিয়নের মাধাইয়া বাজারের ঘটনা। ২৯ ডিসেম্বর (রোববার) দিবাগত রাতে মাধাইয়া বাজারে হওয়া এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৭০টির বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়ে যায়। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পার্শ্ববর্তী ডাকঘর, মসজিদ ও মাদ্রাসাও।
স্থানীয় গণমাধ্যম কুমিল্লার কাগজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাজারের একটি মিষ্টির দোকানের চুলা থেকে আগুনের সূত্রপাত, আশপাশের দোকানে তা ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনায় শুধু হিন্দুদের দোকান আক্রান্ত হয়েছে বা সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন দেওয়া হয়েছে—এমন দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনে মান্নান ভেটেরিনারি নামের একটি ওষুধের দোকানের ৮০ লাখ টাকা ক্ষতি হওয়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও একাধিক মুসলিম ব্যক্তির দোকান এই অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া নিয়ে পোস্ট পাওয়া যায় (১, ২)। ঘটনাটি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে একাধিক গণমাধ্যমও (১, ২, ৩, ৪)।
ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে মাধাইয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি কে এম জামালের সঙ্গে। তিনি ডিসমিসল্যাবকে বলেন, এটি কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়। ক্ষতিগ্রস্ত ৭৩টি প্রতিষ্ঠানের যে তালিকা করা হয়েছে, সেখানে হিন্দুধর্মাবলম্বী ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩-৪টি।
চলতি মাসে প্রকাশিত ডিসমিসল্যাবের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগস্টে বাংলাদেশে হওয়া গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ধর্মীয় অপতথ্যের মধ্যে সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্য জায়গা করে নিয়েছে। এই বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের তুলনায় আগস্ট থেকে নভেম্বরে সাম্প্রদায়িক সংঘাত নিয়ে অপতথ্য ৪৩ শতাংশ ও ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপতথ্যের পরিমাণ ২১ শতাংশ বেড়েছে।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে এই অপতথ্যের ধরনে দুটি বিষয় লক্ষ করা যায়—এক. বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা হয়েছে উগ্র ইসলামপন্থী রাষ্ট্র হিসেবে, যেখানে সংখ্যালঘুরা অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। এই ধরনের ভাষ্য প্রধানত প্রচারিত হয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের দিক থেকে। দুই. বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পেজ ও প্রোফাইল থেকে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায় ও সংগঠনের বিরুদ্ধে। এই দুই ধরনের ভাষ্য একসঙ্গে মিলে সামাজিক বিভাজন ও উত্তেজনা বাড়িয়েছে।