রেলের ৪৮% পদ শূন্য, কাজ চলে দৈনিক মজুরিতে

ট্রেন সার্ভিস দেশের যাত্রী সেবায় বড় ভূমিকা রাখছেছবি: সংগৃহীত

অনুমোদিত জনবলের চেয়ে ৪৮ শতাংশ কম কর্মী নিয়ে চলছে রেলওয়ে। ঘাটতি পোষাতে দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে লোক নিয়োগ দিয়ে কাজ চালিয়ে আসছে সংস্থাটি। এ কাজে আর টাকা দিতে রাজি নয় অর্থ মন্ত্রণালয়।

সংকট কাটাতে স্থায়ীভাবে লোক নিয়োগ দেওয়ার আগে প্রয়োজন হলে ঠিকাদারের মাধ্যমে (আউটসোর্সিং) ঠেকা কাজ চালানোর পরামর্শ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, ঠিকাদারের মাধ্যমে লোক নিয়োগ দিলে খরচ বাড়বে। কারণ, মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে ঠিকাদারের পকেটে কিছু টাকা যাবে। আবার সময়মতো অভিজ্ঞ লোক পাওয়া যাবে না।

এ পরিস্থিতিতে স্থায়ীভাবে অনুমোদিত লোকবল নিয়োগের আগপর্যন্ত দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগপ্রথা চালু রাখার পক্ষে রেলওয়ে। আজ মঙ্গলবার এ বিষয়ে আলোচনার জন্য রেল ভবনে বৈঠক ডেকেছে কর্তৃপক্ষ। রেলের মহাপরিচালক ডি এন মজুমদারের নেতৃত্বে বৈঠকে শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলে বর্তমানে অনুমোদিত জনবলের সংখ্যা ৪৭ হাজার ৬৩৭। তবে কর্মরত ২৪ হাজার ৯৩৩ জন। লোকবলের ঘাটতি ২২ হাজার ৭০৪ জন। অর্থাৎ শূন্যপদের সংখ্যা ৪৮ শতাংশ। রেলের অনুমোদিত জনবলকাঠামো আরও বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত আছে সরকারের। কিন্তু নিয়োগপ্রক্রিয়া বেশ জটিল। মামলা-মোকদ্দমা ও দুর্নীতির কারণে সময়মতো লোকবল নিয়োগ দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ফলে স্টেশনমাস্টার, সহকারী মাস্টার, ট্রেন ও রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের লোকবলের সংকট আছে। এ জন্য রেলওয়ে থেকে অবসরে যাওয়া কর্মী, দীর্ঘদিন ধরে রেলে নানাভাবে যুক্ত ব্যক্তিদের দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে।

রেলের হিসাবে, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে বর্তমানে ৪ হাজার ২৯৬ জনের মতো কর্মী কাজ করছেন। তাঁদের প্রত্যেকের দৈনিক মজুরি সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫৭৫ টাকা। দৈনিক মজুরি খাতে গত অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত ৬০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আগামী অর্থবছরে এর জন্য ৮০ কোটি টাকার মতো প্রয়োজন হবে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় গত জুলাই থেকে এ খাতে বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে দৈনিক মজুরির পরিবর্তে ঠিকাদারের মাধ্যমে লোক নিয়োগের নীতিমালা তৈরি করা হয়। এরপর সব সরকারি দপ্তরকে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে লোক নিয়োগ বন্ধ করার নির্দেশনা দেয়। এবার বাজেটে এই খাতে বরাদ্দই বন্ধ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা যাঁদের দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে থাকে, তাঁদের প্রায় সবাই সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ঠিকাদারের মাধ্যমে এ ধরনের অভিজ্ঞ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোক পাওয়া যাবে না। এতে রেল চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে। গত জুনে রেলপথ মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠিও দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয় আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে লোক নিয়োগ অব্যাহত রাখার অনুমতি দিয়েছে।

রেলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আইনি জটিলতার কারণে সময়মতো সব নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয়। ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়োগ দিলে আরেকটি মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠীর জন্ম হবে। ইতিমধ্যে কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রেলের এই কাজ পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। রেল পরিচালনার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে ঠিকাদারের ওপর নির্ভর করা খুব কঠিন।

অবশ্য আরেকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিজস্ব পছন্দের লোককে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম যে হয় না, সেটাও বলা যাবে না। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় যে লোকবল তৈরি হয়েছে, তাতে ইতিমধ্যে একধরনের অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছে। ঠিকাদারের মাধ্যমে লোক নিয়োগ দিলে সেই অভিজ্ঞ লোক পাওয়া কঠিন হবে। এ ছাড়া এসব কাজের ঠিকাদার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনাও মুশকিল।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, দৈনিক মজুরিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে যেসব কাজ চালানো হয়, তার মধ্যে রয়েছে কারখানার মেরামত, ইঞ্জিন-কোচ ও রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ, স্টেশন ও ট্রেন পরিচালনা, মালামাল সংগ্রহ ও বিতরণ, রেলক্রসিং পাহারা, সংকেতব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণ, বৈদ্যুতিক স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা।

রেলক্রসিং পাহারার দায়িত্বে থাকা একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করা কর্মীদের বেশির ভাগই ৫ থেকে ১০ বছরের অভিজ্ঞ। তিনি নিজেও ৭ বছর ধরে এই কাজ করছেন। এখন ঠিকাদারের মাধ্যমে লোক নিয়োগ হলে তাঁদের কাজ হারানোর আশঙ্কা তৈরি হবে।

রেলওয়ে গত জুনে অর্থ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে বলেছে, রেল পরিচালনা সার্বক্ষণিক চলমান প্রক্রিয়া। অনিয়মিত শ্রমিকেরা দীর্ঘদিন কাজ করার কারণে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছেন। ট্রেন পরিচালনায় তাঁদের নিরাপত্তাজ্ঞানও রয়েছে। ফলে তাঁদের দ্রুততম সময়ে নিয়োগ করা ও কাজে লাগানো যায়। এটা বন্ধ হয়ে গেলে সময়মতো ট্রেন পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সেবা গ্রহণে ২০১৮ সালের নীতিমালায় কিছু ব্যতিক্রমের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, গোপনীয়তা ও সরকারি স্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে কিংবা এই প্রক্রিয়ায় দক্ষ ও বিশেষায়িত সেবা বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকি থাকলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে নীতিমালার আওতার বাইরে লোক নিয়োগ দেওয়া যাবে।’ নীতিমালার এই বিকল্প পথের সুযোগ নিয়ে অনিয়মিত শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে আসছিল রেলওয়ে। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখার পক্ষে সংস্থাটি।

এ বিষয়ে রেলের মহাপরিচালক ডি এন মজুমদার সোমবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রেলওয়ে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে যেসব কাজ পরিচালনা করে, এর সবই কারিগরি–সংশ্লিষ্ট। এ জন্য দক্ষ লোক দরকার। আউটসোর্সিংয়ে সেটা পাওয়া যাবে না বলেই তাঁদের মনে হয়। এ জন্যই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগের প্রক্রিয়া চালু রাখার বিষয়ে চেষ্টা চলছে।