আট বছর পর সমুদ্রে তেল–গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র
অবশেষে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগামী সপ্তাহে নতুন করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এতে অংশ নিতে বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কোম্পানি ইতিমধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ৫৫টি কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে পেট্রোবাংলা।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং বাংলাদেশ তেল–গ্যাস–খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপ চালিয়ে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেছে। ১০ মার্চ আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হতে পারে। দরপত্রে অংশ নিতে বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি ছয় মাস সময় পাবে।
তারা এখন মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে দেশে প্রতিদিন মোট গ্যাস উৎপাদনের ৫৫ শতাংশ সরবরাহ করে। তারাও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে অংশ নিতে আগ্রহী।
সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর গত এক যুগেও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। চারটি বিদেশি কোম্পানি কাজ শুরু করলেও তিনটি ছেড়ে গেছে বঙ্গোপসাগর।
সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সব৴শেষ দরপত্র ডাকা হয়েছিল ২০১৬ সালে। এরপর ২০১৯ সালে নতুন উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) করা হলেও দরপত্র ডাকা হয়নি। প্রায় চার বছর পর গত জুলাইয়ে নতুন পিএসসি চূড়ান্ত অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। বিদেশি কোম্পানির আগ্রহ বাড়াতে এতে আগের চেয়ে সুবিধা বাড়ানো হয়েছে।
২০১২ সালে ভারতের সঙ্গে ও ২০১৪ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা–বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। এখন গভীর সমুদ্রে ১৫টি ও অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক আছে। এর মধ্যে ২০১০ সালে গভীর সমুদ্রে দুটি ব্লকে কাজ নেয় কনোকোফিলিপস। তারা দ্বিমাত্রিক জরিপ চালালেও পরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি পূরণ না হওয়ায় কাজ ছেড়ে চলে যায়। এ ছাড়া একইভাবে চুক্তির পর কাজ ছেড়ে চলে যায় অস্ট্রেলিয়ার স্যান্তোস ও দক্ষিণ কোরিয়ার পস্কো দাইয়ু। এখন একমাত্র কোম্পানি হিসেবে অগভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে অনুসন্ধান চালাচ্ছে ভারতের কোম্পানি ওএনজিসি। এ দুটি বাদ দিয়ে বাকি ২৪টি ব্লকে দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে।
দরপত্রে আগ্রহী যারা
দরপত্রের বাইরে চুক্তির আগ্রহ প্রকাশ করে গত বছর চিঠি দিয়েছিল মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি এক্সনমবিল। এ নিয়ে কয়েক দফা আলোচনাও হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এটি আর এগোয়নি। এরপর নতুন সরকার গঠনের পর আবার আলোচনা করতে আসে এক্সনমবিলের একটি প্রতিনিধিদল। তাদের দরপত্রে অংশ নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়। গভীর সমুদ্রের ১৫টি ব্লকে তারা অংশ নিতে পারে বলে আশা করছে পেট্রোবাংলা।
১৯৯৫ সাল থেকে দেশে গ্যাস উৎপাদনে কাজ করছে আরেকটি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন। তারা এখন মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে দেশে প্রতিদিন মোট গ্যাস উৎপাদনের ৫৫ শতাংশ সরবরাহ করে। তারাও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে অংশ নিতে আগ্রহী। ইতিমধ্যেই তারা পেট্রোবাংলার কাছ থেকে বহুমাত্রিক জরিপের তথ্য কিনে নিয়েছে। নতুন করে আবার আগ্রহ দেখাচ্ছে মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপস। আগ্রহ দেখাচ্ছে চীনের সিনোপ্যাক। এর বাইরে আরও কিছু কোম্পানি যোগাযোগ করতে শুরু করেছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. নূরুল আলম গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, দেশের গ্যাস দরকার। সমুদ্রে গ্যাস পাওয়া গেলে তা বড় প্রাপ্তি। তবে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বড় বিনিয়োগের ঝুঁকি থাকে। তাই বিদেশি কোম্পানিকে আকৃষ্ট করতে পিএসসি হালনাগাদ করা হয়েছে। এটি এখন বিশ্বের তৃতীয় আকর্ষণীয় পিএসসি। এবার বেশ ভালো সাড়া পাওয়া যাবে।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, সমুদ্রে গ্যাস প্রাপ্তির প্রাথমিক সম্ভাবনা যাচাই করতে জার্মানির কোম্পানি স্লামবার্জার বহুমাত্রিক জরিপ চালিয়েছে। এ জরিপের তথ্য কিনে নিতে পারবে দরপত্রে আগ্রহী যেকোনো কোম্পানি। এ ছাড়া কনোকোফিলিপসের পরিচালিত দ্বিমাত্রিক জরিপের তথ্যও আছে পেট্রোবাংলার কাছে। এতেও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেছে বঙ্গোপসাগরে। যদিও অনুসন্ধান কূপ খনন ছাড়া উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত আবিষ্কার করা যায় না। এখন পর্যন্ত কোনো কূপ খনন করা হয়নি সাগরে। তবে একই সমুদ্রে গ্যাস পেয়েছে প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমার।
সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে বিশ্বের ১ নম্বর কোম্পানি এক্সনমবিল আগ্রহ দেখিয়ে বসে আছে। গ্যাসের সম্ভাবনা থাকায় ভালো সাড়া পাওয়ার কথা। বিশ্বের অনেকেই অংশ নিতে পারে।ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম
গ্যাসের দাম ও মুনাফা ভাগাভাগি
পিএসসি-২০১৯ অনুসারে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম রাখা হয়েছিল গভীর সমুদ্রের জন্য সোয়া ৭ মার্কিন ডলার। আর অগভীর সমুদ্রের জন্য দাম ধরা হয় সাড়ে ৫ ডলার। নতুন পিএসসিতে কোনো নির্ধারিত দাম থাকছে না। ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের (অপরিশোধিত জ্বালানি তেল) দামের ১০ শতাংশ গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে-বাড়লে আনুপাতিক হারে গ্যাসের দামও কমবে-বাড়বে। এখন প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৮০ ডলার। এ হিসাবে বঙ্গোপসাগরে গ্যাসের দাম হবে ৮ ডলার। তবে জ্বালানি তেলের দাম ১০০ ডলার হলে গ্যাসের দাম হবে ১০ ডলার।
চুক্তিতে ঠিকাদার হিসেবে আসা বহুজাতিক কোম্পানি ও পেট্রোবাংলার মধ্যকার মুনাফা ভাগাভাগির সূত্র বদল করা হয়েছে এবার। আগে বিনিয়োগ ও পরিচালন খরচ তুলে নেওয়ার পর মুনাফা ভাগাভাগি করত দুই সংস্থা। এতে গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ৫৫ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পেত পেট্রোবাংলা। উৎপাদন বাড়লে পেট্রোবাংলার মুনাফার হার বাড়ত। তবে এবার গ্যাসক্ষেত্র থেকে আয় করা মোট রাজস্বের ওপর ভাগাভাগি করা হয়েছে। এতে ৩৫ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত রাজস্বের ভাগ পাবে পেট্রোবাংলা।
সমুদ্রে প্রথম দরপত্র ’৭৪ সালে
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, ১৯৭৪ সালে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রথম দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে ছয়টি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে পিএসসি সই হয়। এর মধ্যে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় গ্যাস পাওয়ার কথা জানায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ইউনিয়ন গ্যাস কোম্পানি, যার পরে ইউনোকল নাম হয়। তবে খন্দকার মোশতাক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সব কোম্পানি দেশ ছেড়ে চলে যায়। এরপর ১৯৮৮ সালে দরপত্র ডাকা হলেও কেউ অংশ নেয়নি। পিএসসি-১৯৯৪–এর আওতায় অস্ট্রেলিয়ার স্যান্তোসের সঙ্গে চুক্তি হয়। তারা চট্টগ্রামের সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এখান থেকে গ্যাস উৎপাদন করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য মজুত অবশিষ্ট না থাকায় এরপর এটি বন্ধ হয়ে যায়।
পিএসসি-২০০৮–এর আওতায় আসে মার্কিন কনোকো। ২০১৫ সালে তারা চলে যায়। ২০১২ সালে আসে স্যান্তোস, এ অঞ্চলে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কথা বলে ২০২০ সালে তারাও চলে যায়। একই সময় আসে পস্কো দাইয়ু, তারাও চলে যায় পরে। ২০১৯ সালে পিএসসি করা হলেও বিদেশি কোম্পানির তেমন আগ্রহ না থাকায় দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।
প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতা কমানো
পেট্রোবাংলার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বহুজাতিক কোম্পানির পরামর্শে সুবিধা বাড়ানো হয়েছে নতুন পিএসসিতে। আগের পিএসসি নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কোনো আগ্রহ না থাকায় দরপত্র ডাকা যায়নি। এবার দরপত্রে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজস্ব সম্পদ অনুসন্ধানে জোর না দিয়ে মাঝে জ্বালানি আমদানির দিকে ঝুঁকে যায় সরকার। ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। এরপর ডলার–সংকটে আমদানিও ব্যাহত হয়। এখন আবার দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। তবে এতে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হবে।
ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে বিশ্বের ১ নম্বর কোম্পানি এক্সনমবিল আগ্রহ দেখিয়ে বসে আছে। গ্যাসের সম্ভাবনা থাকায় ভালো সাড়া পাওয়ার কথা। বিশ্বের অনেকেই অংশ নিতে পারে। দরপত্রের মাধ্যমে আসায় এটা প্রতিযোগিতামূলক হবে। তবে দরপত্র আহ্বানে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দরপত্র জমার সময় শেষে আর দেরি না করে দ্রুত চুক্তি করা উচিত সরকারের।