আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই হত্যার কিছু মামলার অভিযোগপত্র মের মধ্যে
হাসিনাসহ ১৪৫ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান। এখন পর্যন্ত ২৩টি মামলা (মিস কেস) হয়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৪৫ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এ অভিযোগে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২৩টি মামলা (মিস কেস) হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিছু মামলার অভিযোগপত্র মে মাসের মধ্যে দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগপত্র দেওয়ার পর এ গণহত্যার বিচারপ্রক্রিয়া অচিরেই সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হবে। ২৩ মার্চ সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি, সরকারের চলমান সংস্কার ও নির্বাচন এবং সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ‘রিফাইন্ড বা পরিশোধিত আওয়ামী লীগ’ বিষয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো ‘রিফাইন্ড এলিমেন্ট’ (পরিশোধিত উপাদান) আছে কি না, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় আড়াই মাস পর ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গণ-অভ্যুত্থান ও আওয়ামী লীগ শাসনামলে সংঘটিত গুম, খুন, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে এই ট্রাইব্যুনালে। যদিও এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য। এ পর্যন্ত ৩০০টির মতো অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে ট্রাইব্যুনালে ২৩টি মামলা (মিস কেস) হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মামলার আসামি শেখ হাসিনা। তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল তা গ্রহণ করলে এসব মামলায় আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে। ২০ মার্চ পর্যন্ত ৫০ জনের মতো আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন।
মে মাসের মধ্যে কিছু মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া সম্ভব হবে। অচিরেই বিচারপ্রক্রিয়া সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হবে।আসিফ নজরুল, আইন উপদেষ্টা, অন্তর্বর্তী সরকার
গণহত্যার বিচারে অন্তর্বর্তী সরকার বিলম্ব করছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী যে অপরাধ হয়েছে, তার বিচার দুটি জায়গায় হচ্ছে। একটি ফৌজদারি আদালতে, অপরটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ফৌজদারি আদালতে এত মামলার আধিক্য থাকে যে সেখানে বিচার বিলম্ব হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত ও বিচারে কোনো কাল ক্ষেপণ করা হচ্ছে না। গাফিলতি হচ্ছে না। মনে রাখা উচিত, শেখ হাসিনার আমলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারে গড়ে আড়াই বছর করে সময় লেগেছিল। তদন্ত ও প্রসিকিউশন টিম দিনরাত পরিশ্রম করে যত দ্রুত সম্ভব বিচারকাজ শুরু করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। তিনি মনে করেন, মে মাসের মধ্যে কিছু মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া সম্ভব হবে। এরপর অতিদ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হবে।
কেউ কেউ সংস্কারের অজুহাতে নির্বাচন পেছানোর অভিযোগ করছেন। এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা যে সংস্কারের কথা বলছি, সেটা নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধভাবে করার জন্য। কিছু অতি প্রয়োজনীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। যাতে ভবিষ্যতে কোনো শাসক আবার ফ্যাসিস্ট হওয়ার সুযোগ না পায়। এসব সংস্কারে দ্রুত ঐকমত্য পোষণ করে নির্বাচন প্রক্রিয়া দ্রুততর করার সুযোগ রাজনৈতিক দলগুলোর রয়েছে। প্রথম থেকেই আমরা বলে আসছি, নির্বাচন এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে হবে।’
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, এ দেশে রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে নিষিদ্ধ হয়। বিভিন্নভাবে দলের নিবন্ধন বাতিল হয়। সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদে রাজনৈতিক দলকে সাজা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আবার সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এবং রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশে (দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮) রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে। নির্বাচনী আইনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলের সুযোগও রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দলের নিবন্ধন বাতিলের নজির রয়েছে। ফলে বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধকরণ বা নিবন্ধন বাতিল করার সুযোগ রয়েছে। শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করছে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও জনমতের ওপর।
পরিশোধিত আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন আইন উপদেষ্টা। সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। তাতে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেন, রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। এ পরিকল্পনা পুরোপুরি ভারতের।
পরিশোধিত আওয়ামী লীগ প্রশ্নে মতামত জানতে চাইলে আইন উপদেষ্টা বলেছেন, রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ হবে কি না, আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে কী করা উচিত, তা নিয়ে সমাজে বিভিন্ন মত থাকতে পারে। তবে আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে যা করেছে তাতে, তাদের আবার সক্রিয় হওয়াটা খুব বিপজ্জনক। তাদের মধ্যে রিফাইন্ড (পরিশোধিত) কোনো এলিমেন্ট (উপাদান) আছে কি না, তা নিয়েও মানুষের সন্দেহ রয়েছে।