শাহদীন মালিকের সাক্ষাৎকার
কর্তৃত্ববাদী শাসনে জনগণের অধিকার সংকুচিত করতে আইন করা হয়
ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক। আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, গায়েবি মামলা ইত্যাদি নিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল ইসলাম
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: যেকোনো দেশের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আইনের শাসন। সরকারের পক্ষ থেকে সব সময় দাবি করা হয়, যা করা হচ্ছে, আইন মেনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশে কি আইনের শাসন ঠিকমতো চলছে?
শাহদীন মালিক: সরকার যখন আইন ভঙ্গ করে কোনো কিছু করে, সেটা যে আইনের শাসন নয়, তা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু অনেক সময় আইন অনুযায়ী চললেও আইনের শাসন হয় না। আইনগুলো যৌক্তিক কি না, সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। বর্তমান সরকার অনেক ক্ষেত্রেই অযৌক্তিক বা উদ্ভট আইন করেছে এবং সেই আইন অনুযায়ী শাসন করছে। এ ধরনের শাসনকে আইনের শাসন না বলে উদ্ভট আইনের শাসন বলা যায়।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এ ধরনের উদ্ভট বা অযৌক্তিক আইন সংসদে কীভাবে পাস হয়েছে, এসব আইনের উদ্দেশ্য আসলে কী?
শাহদীন মালিক: আমাদের সংসদে যে খসড়া আইন বা বিল উত্থাপিত হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা প্রায় হুবহু পাস হয়ে যায়। এর কারণ হলো, সংসদ সদস্য অর্থাৎ, আইনপ্রণেতারা অধিকাংশ ব্যবসায়ী। এসব আইন বোঝা বা এগুলোর ভালো-মন্দ নিয়ে তাঁদের কোনো উৎসাহ বা আগ্রহ নেই। ফলে সরকার যা ইচ্ছা তাই আইন পাস করিয়ে নিতে পারে। ক্ষমতা বা শাসন টিকিয়ে রাখতে সরকার তার প্রয়োজনমতো আইন করছে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: একটি দেশে প্রচলিত আইনে কি সেই দেশের সরকারের চরিত্র বা শাসনব্যবস্থার প্রতিফলন থাকে? তাহলে আমাদের দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো বিভিন্ন দমন-পীড়নমূলক আইনের উপস্থিতি কিসের প্রতিফলন?
শাহদীন মালিক: গণতান্ত্রিক দেশে আইনের উদ্দেশ্য থাকে জনগণের অধিকার বিস্তৃত করা। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক আইনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার সংকুচিত করা হয়েছে। তবে এটা শুধু আমাদের সরকার বা এই সময়ের বিষয় নয়, পৃথিবীর যেকোনো দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলেই এটা হয়ে থাকে। সম্প্রতি একটি সুইডিশ সংস্থার প্রতিবেদনেও বাংলাদেশকে কর্তৃত্ববাদী দেশের তালিকায় রাখা হয়েছে। আমরা যেহেতু একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের মধ্য রয়েছি, ধরেই নিতে হবে এখানে জনগণের অধিকার সংকুচিত করার আইন হবে। অধিকার প্রশস্ত করার, বিস্তৃত করার কোনো আইন কর্তৃত্ববাদী সরকার করে না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বেশ কিছুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা হচ্ছে। মামলা গায়েবি হলেও ভোগান্তিটা গায়েবি নয়। এ রকম অবস্থায় ভুক্তভোগীদের করণীয় কী?
শাহদীন মালিক: পত্রপত্রিকায় গায়েবি মামলা সম্পর্কে পড়ে আমি যতটুকু বুঝেছি, যা বাস্তবে ঘটেনি এ রকম কোনো কিছু, যেমন বোমা বা ককটেল বিস্ফোরণের ভুয়া ঘটনা সাজিয়ে মামলা দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু বোমা বিস্ফোরণ একটি গুরুতর অভিযাগ, তাই পুলিশের পক্ষে তাঁদের গ্রেপ্তার করতে সুবিধা হয়। আদালতও হয়তো অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সহজে জামিন দিতে চান না। কিন্তু অভিযোগের সত্যতা না থাকায় একসময় তাঁরা জামিন পেয়ে যান বা মামলা খারিজ হয়ে যায়। সমস্যাটা হলো ভোগান্তিটা। পুলিশ ভোগান্তিটা করতে পারছে, কারণ, এ ধরনের ঘটনায় তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। জবাবদিহি করতে হলে তারা এ রকমভাবে মামলা দিতে পারত না। সরকার হয়তো নিজের স্বার্থেই এই জবাবদিহি কার্যকর করছে না। যদিও আমাদের দেশে খুব একটা প্রচলন নেই, তবু এ রকম অবস্থায় ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণের মামলা করা ছাড়া উপায় দেখছি না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বিচার বিভাগ পৃথক্করণের প্রায় দেড় দশক পেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ এখন কতটা স্বাধীনভাবে চলছে বলে মনে করেন?
শাহদীন মালিক: বিচার বিভাগের পৃথক্করণকে দুটি প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে। এর একটি হলো বিচারকাজ ও রায়ের বিষয়ে বিচারকদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। আরেকটি হলো বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলির বিষয়গুলো। আইন অনুযায়ী বিচারকাজ ও রায়ের বিষয়ে বিচারকদের স্বাধীনতা আছে বলে মনে করি। কিন্তু নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলির বিষয়ে বিশেষ করে, নিম্ন আদালতের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের এখনো যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এটা স্বীকার করতেই হবে, বিচারব্যবস্থার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের হাতে নেই। এ কারণে সরকার বা নির্বাহী বিভাগ অসন্তুষ্ট হতে পারে—এমন কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারকেরা অস্বস্তি বা আশঙ্কা বোধ করতেই পারেন। এই অস্বস্তি বা আশঙ্কা বিচারকাজকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: রাজনৈতিক বিষয় আদালতে নিয়ে আসার উদাহরণ অতীতেও দেখা গেছে। সম্প্রতি এ রকম একটি ঘটনা লক্ষ করা যাচ্ছে। জি এম কাদেরকে জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান হিসেবে অবৈধ ঘোষণার ডিক্রি চেয়ে আদালতে মামলা চলছে। এ ঘটনাকে কীভাবে দেখছেন?
শাহদীন মালিক: রাজনৈতিক দলগুলো পরিচালিত হয় গঠনতন্ত্র অনুসারে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা, ২০০৮-এর শর্তাবলি পূরণ করার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। গঠনতন্ত্র, আইন বা বিধি ভঙ্গ করলে কোনো দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু জি এম কাদেরের বিষয়টি নিয়ে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে, কারণ, ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাঁর ভূমিকা সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। আশা করি, আদালত এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। আদালতের ভাবতে হবে, এ ঘটনার যেমন আইনি দিক রয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক দিকও রয়েছে। আদালতের এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না, যাতে জনমনে বিচার বিভাগের ওপর অনাস্থা আরও বেড়ে যায়।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনার মতে বর্তমানে বিচার বিভাগের কোন বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত?
শাহদীন মালিক: বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিচারপ্রার্থীদের যথাসম্ভব দ্রুত ন্যায়বিচার দিতে হবে। কিন্তু আমাদের বাজেটে বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ খুবই কম দেওয়া হয়। এটা বিচার বিভাগের দুর্বলতার অন্যতম কারণ। কম বরাদ্দ মানে জনবল, অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা। ১৭ কোটি মানুষের দেশে বিচারকের সংখ্যা ২ হাজারেরও কম। এই যে লাখ লাখ মামলার জট লেগেছ, এর কারণও বিচারকের সংখ্যা কম। বিচারকের সংখ্যা না বাড়ালে, বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি না করলে বিচার বিভাগ গতিশীল হবে না। বিচার বিভাগ গতিশীল না হলে বিচারপ্রার্থীরা সময়মতো বিচার পাবেন না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
শাহদীন মালিক: আপনাকেও ধন্যবাদ।