ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ

ধর্ষণের প্রতিবাদে রংপুরের টাউন হলের সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাছবি: মঈনুল ইসলাম

দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ ও নারী-শিশুসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবাদ সমাবেশ, বিক্ষোভ, মোমবাতি প্রজ্বালন ও মশালমিছিল হয়েছে।

প্রতিবাদ কর্মসূচিগুলো থেকে এসব অপরাধ দমনসহ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কর্মসূচিতে বলা হয়েছে, দেশের মানুষের নিরাপত্তা, বিশেষ করে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা গেলে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হবে।

রোববার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ এবং রংপুর কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব কর্মসূচি পালন করা হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

রোববার দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন একদল শিক্ষার্থী। মিছিলটি কয়েকটি সড়ক ঘুরে একই স্থানে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।

সমাবেশে বক্তারা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের দাবি জানান। একই সঙ্গে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে ছিনতাই ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।

সারা দেশে ধর্ষণ, ছিনতাই ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। আজ রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে
ছবি: প্রথম আলো

সমাবেশে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী নিবিড় ভূঁইয়া বলেন, ‘ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশের কোথাও নির্বিঘ্নে যাতায়াত করা যাচ্ছে না। জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই। মনে হচ্ছে, এই বুঝি ছিনতাই করে নিল সবকিছু। অবিলম্বে প্রত্যেক নারী ও ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করে দ্রুত ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার করতে হবে। একই সঙ্গে দ্রুত যাতে বাংলাদেশের ল অ্যান্ড অর্ডার ফাংশন করে, তার জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার যে দায়িত্ব, সেটি পালন করতে হবে। তা না হলে জাহাঙ্গীরনগর থেকে আমরা ঘোষণা দিতে চাই, আপনাকে টেনেহিঁচড়ে নামাতে আমরা এক মিনিটও সময় নেব না।’

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়

গত শনিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মশালমিছিল ও সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের গোলচত্বর থেকে শুরু হয়ে শিক্ষা ভবন ‘ই’ থেকে ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে গিয়ে শেষ হয়।

মশালমিছিলে শিক্ষার্থীরা ‘লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’, ‘নারীর পীড়ন যেখানে, লড়াই হবে সেখানে’, ‘ধর্ষকদের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘গোলামি না আজাদি, আজাদি, আজাদি’, ‘রাজশাহীতে ধর্ষণ হয়, ইন্টেরিম কী করে’ প্রভৃতি স্লোগান দেন।

অপরাধীদের দ্রুত বিচার ও নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে মশালমিছিল ও সমাবেশ করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শনিবার রাতে ক্যাম্পাসে
ছবি: প্রথম আলো

মিছিল–পরবর্তী সমাবেশে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী সুলতানা আক্তার লুবনার সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেরাব সাদাত, শিল্প ও উৎপাদন প্রকৌশল বিভাগের পলাশ বখতিয়ার, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ফয়সাল হোসেন, মুরারি চাঁদ কলেজের (এমসি কলেজ) শিক্ষার্থী তানজিনা বেগম, শাবিপ্রবির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের মালিহা নুসরাত ও ইংরেজি বিভাগের নাজনীন লিজা।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

রোববার বিকেল পাঁচটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা চত্বর এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেন চুয়েটের শিক্ষার্থীরা। সমাবেশে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী বিভিন্ন লেখাসংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে অংশ নেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ শাস্তি কার্যকরের দাবি জানান।

সমাবেশে কম্পিউটারবিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মেহরীন রহমান বলেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও আইনি দুর্বলতার কারণেই এসব অপরাধ বারবার ঘটছে। শুধু কঠোর শাস্তি নয়, সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষার প্রসার এবং নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে এই অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলে সত্যিকার অর্থে কোনো পরিবর্তন আসবে না।’

নারী ও শিশু ধর্ষণের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও মশালমিছিল। রোববার সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে
ছবি: প্রথম আলো

বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা মশালমিছিল বের করেন। মিছিলটি চুয়েটের স্বাধীনতা চত্বর এলাকা থেকে শুরু হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

শনিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন-১–এর নিচতলায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। পরে শিক্ষার্থীরা ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির ঘটনায় বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।

শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে সংহতি জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শুচিতা শরমিন, প্রক্টর সনিয়া খান, সহকারী প্রক্টর এবং বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী নিপীড়ন প্রতিরোধ সেল গঠন ও সংগঠনটির সক্রিয় কার্যক্রম নিশ্চিত করার দাবি জানান।

সারা দেশে ধর্ষণের প্রতিবাদে রোববার রাত নয়টার দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রদীপ প্রজ্বালন করে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন
ছবি: প্রথম আলো

সমাবেশে মৃত্তিকা ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সুজয় শুভ বলেন, ‘ধর্ষণ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। নারীদের পণ্য হিসেবে দেখার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত নারীদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করতে হবে।’

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহানের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ভূমিকা সরকার, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের নিশাত মালিহা, জাহিদুল ইসলাম, আইন বিভাগের আবদুর রহমান, ইসরাতুন্নেহা প্রমুখ।

বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ

রোববার দুপুরে বিএম কলেজ ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্টে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে এ বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। সমাবেশে বক্তারা বলেন, দেশের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সমাবেশে বক্তব্য দেন, বিএম কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সুজয় সরকার, সাংগঠনিক সম্পাদক অনুপ রায়, মারিয়া মারজান, প্রীতিলতা ব্রিগেডের আহ্বায়ক শর্মী ইসলাম, তন্নী দাস, সাদমান ইশরাক, লামিয়া ইসলাম, শুভদ্বীপ প্রমুখ।

সারা দেশে ধর্ষণের প্রতিবাদে সোমবার বরিশালের বিএম কলেজে মানববন্ধন ও সমাবেশ
ছবি: প্রথম আলো

সুজয় সরকার বলেন, ‘ধর্ষণের বিরুদ্ধে আজ শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়েছে। বিচারের জন্য আজকে কেন আমাদের দাঁড়াতে হবে? কেন দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দিন দিন বেড়ে চলছে। আইনশৃঙ্খলা অবনতির কারণে আজকে সারা দেশে নারীদের শ্লীলতাহানি, নারী নির্যাতনসহ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।’

রংপুর

রোববার বেলা তিনটার দিকে রংপুর নগরের টাউন হল চত্বরের সামনে রংপুর কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতাধিক শিক্ষার্থী বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জড়ো হন। তাঁরা ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন ও স্লোগান দেন এবং জাহাজ কোম্পানি-মেডিকেল মোড় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।

রংপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী তাহা ফাতেমা হাসান বলেন, ‘গত ৪৮ ঘণ্টায় ১৮-১৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু ধর্ষকেরা গ্রেপ্তার হচ্ছে না। তাহলে আমরা মেয়েরা নিরাপদ কোথায়? এ জন্য আমরা একত্র হয়েছি। যতক্ষণ না বিচার পাব, আমরা রাজপথ ছাড়ব না।’

ধর্ষণের প্রতিবাদে রংপুরে নগরে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিল শেষে নগরের পায়রা চত্বরে ধর্ষকের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়
ছবি: মঈনুল ইসলাম

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগর উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ, যুগ্ম আহ্বায়ক মোতাওয়াক্কীল বিল্লাহ শাহ ফকির, মুখপাত্র নাহিদ হাসান খন্দকার, জেলা কমিটির আহ্বায়ক ইমরান আহমেদ, সদস্যসচিব আশফাক আহমদ প্রমুখ।

পৌনে এক ঘণ্টাব্যাপী অবস্থান কর্মসূচির পর বিক্ষোভকারীরা টাউন হল থেকে পায়রা চত্বরে মিছিল নিয়ে যান। সেখানে ধর্ষণের ঘটনার বিচার চেয়ে প্রতীকী এক ধর্ষকের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রতিনিধি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল ও রংপুর]