‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ ফেসবুকে লেখার ৫ দিনের মাথায় থেমে যায় তানজিনার পথচলা
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তানজিনা নওরিন (এশা) ২৪ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে বেশ কয়েকটি ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’। এর পাঁচ দিনের মাথায় ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের রেস্তোরাঁ ভবনে আগুনে মারা যান তিনি।
আগুন ও ধোঁয়া বাড়ছে দেখেও তানজিনা আগে নিচে নামার চেষ্টা করেননি। গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনটির দ্বিতীয় তলায় বিরিয়ানির দোকান ‘কাচ্চি ভাই’–এ ছিলেন তানজিনা ও তাঁর পাঁচ স্বজন। ওই রেস্তোরাঁর জানালা ভেঙে বেরিয়ে মই বেয়ে নিচে নামেন তানজিনার খালাতো ভাইয়ের স্ত্রী লামিয়া তাবাসসুম, লামিয়ার পাঁচ ও তিন বছর বয়সী দুই মেয়ে, লামিয়ার অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া এক ভাই আর তানজিনার ছয় বছর বয়সী ছেলে আরহাম আহমেদ। বাচ্চারা আগে নামার পর লামিয়া নামতে নামতেই বিস্ফোরণ ঘটে। তানজিনা লামিয়াকে শুধু বলেছিলেন, ‘আরহামকে নিয়ে যাও।’
এতগুলো মানুষ আগুন থেকে বেঁচে ফিরলেও পরিবারটির সদস্যদের মধ্যে তার কোনো উচ্ছ্বাস নেই। কেননা, সবার প্রিয় তানজিনাকেই তো তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন। ঘটনার পর ২০ দিনেও লামিয়া সেদিনের ঘটনার কোনো ভিডিও বা খবর দেখেননি। আসলে তা দেখার সাহস পাননি তিনি। আরহামসহ অন্যরাও মানসিক ট্রমার মধ্যে আছে। গেল ১৫ মার্চ ছিল তানজিনার জন্মদিন। এবার আর তাঁর জন্মদিন উদ্যাপনের কোনো তাড়া ছিল না পরিবারে।
পিরোজপুরের মেয়ে তানজিনা। গ্রামের বাড়িতে নানি, খালা আর মামাদের আদরে এবং খালাতো, মামাতো ভাইবোন ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হেসেখেলে বড় হয়েছেন তানজিনা। তাঁর মা শাহানা পারভীন আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন, একমাত্র মেয়ের এভাবে মৃত্যুর পর তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
কথা হয় তানজিনার স্বামী একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত নাদিম আহমেদের সঙ্গে। ছেলে আরহাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছয় বছর বয়সী ছেলে সব বুঝতে পারছে। বাচ্চাটা ট্রমার মধ্যে আছে। রাতে ‘আম্মু কই’ বলে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। মোবাইল থেকে মায়ের ছবি বের করে দেখে।’ নাদিম আহমেদের মায়ের কাছে থাকছে আরহাম।
৯ বছরের বিবাহিত জীবন নাদিম-তানজিনা দম্পতির। নাদিম ঘটনার সময়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত আটটার দিকে স্ত্রী তাঁকে ফোন করে বলেছিলেন, বাসায় নুডলস রান্না করা আছে, তিনি যেন খেয়ে নেন। তারপর রাত নয়টার দিকে আগুনের খবর শোনেন নাদিম। বেইলি রোডে গিয়ে আগুনের ভয়াবহতা দেখে নাদিম নিজেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। নাদিমের আক্ষেপ, ‘ও (তানজিনা) তো কাচ্চি বা মুরগি খেত না। সেদিন ও কেন যে গেল...।’
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি তানজিনা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন। ওই ভবনে আগুন লেগে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর এই তালিকায় তানজিনার নামটিও যোগ হয়েছে।
লামিয়া এখনো ‘বিশ্বাস করতে পারছেন না’
তানজিনা মারা গেছেন, তা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না তাঁর খালাতো ভাইয়ের স্ত্রী লামিয়া তাবাসসুম। তিনি জানান, ভাবি–ননদের সম্পর্কের বাইরে তাঁরা ছিলেন দুই বন্ধু। লামিয়া পিরোজপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন, আবার পিরোজপুরে ফেরার কথা ছিল। তাই তানজিনা অসুস্থ শরীর নিয়ে ছেলেকে সঙ্গে করে ইস্কাটন গার্ডেনের বাসায় লামিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তানজিনার বাসা ছিল রামপুরায়। এরপর বাচ্চারা কিছু খাবে, তাই তাঁরা রিকশায় চড়ে বেইলি রোডে গিয়েছিলেন। আগুন লাগার আগেই তাঁদের খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন।
লামিয়া বলেন, ‘তানজিনা হাসিখুশি থাকতেন সব সময়। সাজতে পছন্দ করতেন। খাওয়ার আগেও তিনি ব্যাগ থেকে লিপস্টিক বের করে লামিয়ার মেয়েদের সাজিয়ে দিয়েছিলেন। তানজিনা নিজের মোবাইলে অনেকগুলো ছবি তোলেন, মোবাইলটি পাওয়া যায়নি, তাই ওই ছবিগুলোও আর কখনো পাওয়া যাবে না।’
যেকোনো বিপদে অল্পতেই ঘাবড়ে যেতেন তানজিনা। তবে সেদিন ঘটনার পর তানজিনা একদম চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন উল্লেখ করে লামিয়া বলেন, তানজিনারও নিচে নামার কথা ছিল; কিন্তু তারপর তো সবই শেষ।
লামিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যখন বাইরে অল্প আগুন, তখন তিনি কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁর একটি জানালা খুলে ফেলেন। তবে রেস্তোরাঁটির কর্মীরা এসে রাগারাগি করে তা বন্ধ করে দেন। পরে তাঁরা বের হয়ে ছাদে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু দরজা বন্ধ থাকায় তাঁরা বের হতে পারেননি। পরে লামিয়ার অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া ভাই আবার জানালা খুললে এক কর্মী এসে থাপ্পড় লাগায়। তারপরও জানালা বন্ধ না করে ওই জানালা দিয়েই তাঁরা সবাই বাইরে বের হন।
আগুন লেগেছিল ভবনের নিচে একটি চা-কফির দোকানে। সেখান থেকে আগুন ভবনে ছড়িয়ে পড়ার আগে দোতলা থেকে অনেকে মই বেয়ে নিচে নেমেছিলেন।
লামিয়া বলেন, ‘কাচ্চি ভাইয়ের ভেতরে তিনটি জানালা ছিল। অল্প আগুন যখন ছিল, তখনই জানালাগুলো খুলে দিলে অন্তত ১০ জনকে বাঁচানো সম্ভব হতো। আর ভবনের নিচে অনেক মানুষ ছিলেন, তাঁদের অনেকেই মোবাইলে আগুনের ভয়াবহতার ভিডিও করতে ব্যস্ত ছিলেন।’
ফেসবুকে স্বজনদের আহাজারি
ঘটনার পর তানজিনার খালাতো বোন নাজিয়া খালেদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আগে কোনো দুর্ঘটনার সময় কেউ লাইভ করছে বা ভিডিও করছে দেখলে খুব রাগ লাগত। মনে হতো ফোনটা রেখে মানুষ বাঁচানোর চেষ্টা করে না কেন? তবে এ ঘটনার পর ফেসবুক, ইউটিউবে একটার পর একটা ভিডিও দেখেছি। কাঁদতে কাঁদতে খুঁজেছি আমার বোনটা কই ছিল, কেন নামতে পারেনি। পরে আমি সব উত্তর পেয়েছি। আমরা যখন হাসপাতালে এশার (তানজিনা) পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখনো মানুষ ভিডিও করছে দেখে রাগ লাগছিল। এখন আর লাগছে না। হয়তো ওই ভিডিও দেখেই কেউ কারও স্বজনকে খুঁজে পেয়েছেন। কারণ, এই দেশে তো কোনো সিস্টেম নাই।’
শিশুদের আবদার মেটাতেই তাঁর বোন আর ভাইয়ের স্ত্রী রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন জানিয়ে নাজিয়া লিখেছেন, ‘এমন পরিণতি হবে জানলে কেউ কি যেত? কোনো মা যায়?’
এ ঘটনা নিয়ে কোনো কোনো গণমাধ্যমে যেভাবে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে, তার সমালোচনা করেন নাজিয়া। তিনি লিখেছেন, ‘মিডিয়ায় বারবার বলছে, ছেলের আবদার মেটাতে মা মারা গেছেন। আমাদের আশপাশের অনেকেই বলছেন। আমার আকুল আবেদন আপনাদের কাছে, দয়া করে ছেলের আবদার মেটাতে গিয়ে মা চলে গেলেন, এটা আর বলবেন না। শিশুরা খুব কোমল মনের হয়। ওর মনে কোনো দাগ পড়ুক আমি চাই না। বড় হয়ে বা এখনো ওর মায়ের মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করুক, সেটা আমরা কেউ চাই না।’
ঘটনার পর বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং তানজিনার মামাতো ভাই সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাজমুস সাকিব একটি রিট আবেদন করেন।
নাজমুস সাকিব প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা আর যাতে না ঘটে এবং বেইলি রোডের আগুনের ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।