‘স্বপ্ন ছিল মাটির ঘরের, হয়েছে রিসোর্ট’
সুলতানা নাহারকে আড়ালে কেউ কেউ খ্যাপাটে ডাকে। নিয়মকানুনের হেরফের হলে তাঁর মেজাজমর্জি ঠিক থাকে না। তাঁর পরিচয়ও অনেক। তিনি একজন আইনজীবী। একসময় সুপ্রিম কোর্টে আইনি পেশায় যুক্ত ছিলেন। আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া কবি ও একজন টেনিস খেলোয়াড়ও তিনি। ষাটের দশকে বৃত্তি নিয়ে লেখাপড়া করে এসেছেন পাকিস্তানের লাহোর থেকে।
সুলতানা নাহারের বয়স এখন ৭৬ বছর। রাজধানীর শ্যামলীতে নিজের বাড়ি; সবকিছু ছেড়ে এ বয়সে তিনি বসবাসের জন্য বেছে নিয়েছেন নির্জন স্থান। এখন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। থাকেন রাধানগরে। মাঝেমধ্যে গোলাম আলীর গজল কিংবা মোহাম্মদ রফির গান বাজিয়ে বসে থাকেন। তবে শুধুই আরাম-আয়েশ করেন—এমন কিন্তু নয়।
শ্রীমঙ্গলের রাধানগরে পর্যটন পুলিশের ক্যাম্প অতিক্রম করে একটু এগিয়ে ডানে সাদা রঙের গেটের ভেতর প্যারিসের কফি শপের মতো উন্মুক্ত চত্বর। সেখানে সাদা রঙের বেঞ্চে বসে দিনের বেলা চা খাওয়া, বই পড়া, ল্যাপটপ নিয়ে লিখতে বসা যায়।
গত ১৪ ডিসেম্বর রাতে শ্রীমঙ্গলের তাপমাত্রা ছিল ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। হাড়–কাঁপানো ঠান্ডার সঙ্গে ছিল ঘন কুয়াশা। দুই হাত দূরের বস্তুও তখন অস্পষ্ট। সেই পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শোনা গেল কুয়াশা ভেদ করে দূরে কোথাও বেজে চলেছে গজলের সুর—‘হাঙ্গামা হ্যায় কিউ...’। টিলা আর চা–বাগানের ভেতর দিয়ে ভেসে আসছে ঘন কুয়াশা। রাত তখন ১০টা।
দিনের বেলা দেখা গেছে, রাধানগরে পর্যটন পুলিশের ক্যাম্প অতিক্রম করে একটু এগিয়ে ডানে সাদা রঙের গেটের ভেতর প্যারিসের কফি শপের মতো উন্মুক্ত চত্বর। সেখানে সাদা রঙের বেঞ্চে বসে দিনের বেলা চা খাওয়া, বই পড়া, ল্যাপটপ নিয়ে লিখতে বসা যায়। সেই চত্বর অতিক্রম করে একটা ছোট্ট ঘর। সেখান থেকেই এ রাতে ভেসে আসছিল গানের সুর।
এগিয়ে দেখি ঠান্ডার ভেতর বসে আছেন সুলতানা নাহার। টেবিলে লেখার প্যাডের পাতায় জলছাপে আঁকা একটি ছবি। ঘরে বাঁয়ের দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলোর মধ্যে এ ছবিটাই রঙিন দেখা গেল। গ্রীবা উঁচিয়ে রাখা এক তরুণীর হাসিমুখে চেয়ে থাকার মুহূর্তের ছবি। সুলতানা নাহার জানালেন, সত্তরের দশকে তিনি মা হওয়ার তিন থেকে চার ঘণ্টা পর তোলা হয়েছিল ছবিটি। বলেন, ‘ছেলে হওয়ার পর গরম পানিতে গোসল করে চুল শুকাতে বসেছিলাম। আমার ভাই ক্যামেরায় এই ছবিটি তুলে ফেলেছিল।’
সুলতানা নাহার ১৯৬৪ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাড়ির মুরব্বিদের চিঠি লিখে লাহোরে পড়তে চলে গিয়েছিলেন। আগে কাউকে জানতেও দেননি প্রস্তুতি নিচ্ছেন ও শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছেন। তাঁর বাবা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের পুলিশ কর্মকর্তা।
মা হওয়াটা উদ্যাপনের ব্যাপার বলে মনে করেন এই নারী। বলেন, ‘শরীরের দুর্বলতা থাকবে, তাই বলে আমি সাজগোজ করব না!’
সুলতানা নাহার জীবনের সবকিছু যেন উদ্যাপনের মধ্য দিয়েই করেন। ১৯৬৪ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে লাহোর পড়তে গিয়েছিলেন বাড়ির মুরব্বিদের চিঠি লিখে। আগে কাউকে জানতেও দেননি, প্রস্তুতি নিচ্ছেন ও শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছেন। তাঁর বাবা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের পুলিশ কর্মকর্তা।
সুলতানা নাহারের বিয়ে হয় কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে ১৯৬৫ সালে। তিনি ছিলেন এনবিআরের বোর্ড মেম্বার। স্বামী লং টেনিস খেলতেন বলে তিনিও রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাবসহ বিভিন্ন জায়গায় টেনিস খেলতে শুরু করেন।
সংসার, চার সন্তান সামলে সুলতানা নাহার লেখাপড়া শেষ করেন। আইন বিষয়ে লেখাপড়া শেষে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন। এত কিছুর মধ্যে নিজের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন কবিতা লেখা। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা থেকে বের হয়েছে তাঁর লেখা কবিতা। ১৯৮৯ সালে পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ডেন পোয়েট অ্যাওয়ার্ড।
অন্য জায়গা থেকে এসে এত বয়সে একজন নারীর এখানে রিসোর্ট ব্যবসা সামলানো মুখের কথা নয়। সুলতানা নাহার আপা যেমন শক্ত মানুষ, আবার বেশ মিশুকও। এ বয়সে এসেও ঠিকই নিজের ইচ্ছা পূরণ করেছেন।কাজী শামসুল ইসলাম, নিসর্গ নীরব ইকো কটেজের মালিক
পাকিস্তানের বিখ্যাত কবি আহমেদ ফয়েজ ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে এসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সুলতানা নাহারকে। প্রগতিশীল প্রখ্যাত উর্দু কবি নওশাদ নূরীর বাড়িতে সে উপলক্ষে বসেছিল এক আসর। প্রয়াত কবি নওশাদ নূরীর ছেলে ব্যাংক এশিয়ার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হাইকেল হাশমী একটা ছবি দেখিয়ে প্রথম আলোকে বললেন, ‘আহমেদ ফয়েজ দুবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। এটা দ্বিতীয়বার, ১৯৯৯ সালে আমাদের বাসায় তোলা। সুলতানা নাহার এসেছিলেন, মনে আছে।’
সুলতানা নাহারের সন্তানেরা দেশে–বিদেশে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ২০০৮ সালে স্বামী কাজী আনোয়ার হোসেন মারা যাওয়ার পর হঠাৎ বদলে যায় তাঁর জীবন। ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায় শক্তপোক্ত মানুষটার। ২০০৯ সালে তাঁর ছোট ভাই বড় বোনকে নিয়ে শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে এসেছিলেন।
তখন শ্রীমঙ্গলের রাধানগর একরকম অচেনা। এত কটেজ, রিসোর্ট, হোটেল হয়নি। তখনো অনেক দূরের টিলার চা–বাগান দেখা যায়। পাহাড়ি ছড়ার শব্দ শোনা যায়। প্রকৃতির প্রেমে পড়লেন সুলতানা। বললেন, ‘ভেবেছিলাম একটা মাটির ঘর বানাব। উচ্ছেগাছ লাগাব। গাছ থেকে ছিঁড়ে সেই উচ্ছে ডলে ভাত খাব। কেউ খুঁজে পাবে না আমাকে।’
তখন সুলতানা নাহারের বয়স ৬৩ বছর। তিনি শ্রীমঙ্গলে থাকতে চান শুনে পরিবারের সবাই বলেছিলেন, আবার পাগলামো শুরু হয়েছে। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন সুলতানা নাহার।
এরপর ধাপে ধাপে শুরু হয় সুলতানার রিসোর্ট তৈরির কাজ। বলেন, ‘এসেছিলাম শান্তির খোঁজে। প্রথমে ছোট ঘর করেছি। কিন্তু পর্যটক এদিকে এলে দেখি জানতে চায়, থাকার ব্যবস্থা আছে কি না? শুনতে শুনতে মনে হলো, দু–একজন অতিথি থাকলে ভালোই তো হয়। এরপর একটু একটু করে বড় হতে শুরু করে রিসোর্টের পরিধি।’
সুলতানা নাহার বলেন, ‘এই যে আধা শতাংশ, এক শতাংশ করে জমি কিনে রিসোর্টের জায়গা বাড়ানো হয়েছে, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। প্রতিবার একটু জমি কিনি আর আগের দেয়াল ভেঙে আবার নতুন সীমানাপ্রাচীর বানাই।’
এ রিসোর্টের কাছে ‘নিসর্গ নীরব ইকো কটেজ’। কটেজের মালিক স্থানীয় বাসিন্দা কাজী শামসুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্য জায়গা থেকে এসে এত বয়সে একজন নারীর এখানে রিসোর্ট ব্যবসা সামলানো মুখের কথা নয়। সুলতানা নাহার আপা যেমন শক্ত মানুষ, আবার বেশ মিশুকও। এই বয়সে এসেও ঠিকই নিজের ইচ্ছা পূরণ করেছেন।’
ভেবেছিলাম একটা মাটির ঘর বানাব। উচ্ছেগাছ লাগাব। গাছ থেকে ছিঁড়ে সেই উচ্ছে ডলে ভাত খাব। কেউ খুঁজে পাবে না আমাকে।সুলতানা নাহার, হারমিটেজ রিসোর্টের উদ্যোক্তা
রাধানগরের ‘হারমিটেজ’ নামের রিসোর্টে এখন অনেক বিখ্যাত মানুষ অতিথি হয়ে আসেন। প্রখ্যাত মার্কিন কথাসাহিত্যিক জন সিলভার হারমিটেজে এসেছিলেন ২০২২ সালে। সুলতানা নাহারের ছেলে কাজী আতিফ আনোয়ার যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে শিক্ষকতা করেন। আরেক ছেলে কাজী আরশাদ আনোয়ারও যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। ছেলে কাজী আসিফ আনোয়ার থাকেন ঢাকায়। ছোট ছেলে আরিফ আনোয়ার কানাডায় শিক্ষকতা করেন।
স্টর্ম বইয়ের লেখক আরিফ আনোয়ার প্রথম আলোকে বললেন, ‘আম্মা বয়স নিয়ে ভেবে কোনো কিছু থেকে পিছিয়ে আসার মানুষ নন। সব সময়ই একের পর এক কিছু না কিছু করছেন। কোনোটি সফল হয়, কোনোটি কম সফল হয়। দেখুন, সবার মা–বাবা একটা করেই হয়। আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার আম্মার নতুন নতুন উদ্যোগ।’
বয়সের কথা তুলেছিলাম সুলতানা নাহারের কাছে। ৭৯ বছরের সুলতানা বললেন, ‘বয়স শুধু সংখ্যা—কথাটা একদম ভুল। সময়, শক্তি সবই শরীরে প্রভাব ফেলে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে মানুষের মন।’ আরও বললেন, ‘নারী বলে, মেয়ে বলে পারব না—এই ভাবনা আপনাকে যতটা দুর্বল করে দেবে, বয়স তা পারবে না। আরেকটা কথা, আমি না সব সময়ই একটু খ্যাপাটে ছিলাম; যা করতে চাই, তা শুরু করতে দুবার ভাবি না। ব্যর্থ হওয়া, সফল হওয়া—সেসব পরের কথা।’
গুণী এই নারী বলেন, ‘কটেজের নাম রেখেছি হারমিটেজ, এখানকার অধিকাংশ মানুষ এই শব্দের অর্থই জানে না। তাদের নিয়েই কিন্তু আমি রিসোর্ট তৈরি করেছি। মনের ওপর বয়সের সংখ্যাটা চাপতে দেবেন না। এই কটেজ আমার এক এক বিন্দু রক্ত দিয়ে তৈরি। পেরেছি, কারণ ইচ্ছাটা ছিল।’