প্রতি ২০০ ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে একজন মারা যাচ্ছেন
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ২ হাজার ৭৬৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি। রোগীর এই সংখ্যা চলতি বছরে এক দিনে সর্বোচ্চ।
এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত প্রতি ২০০ জনের মধ্যে একজন মারা যাচ্ছে। আর রাজধানী ঢাকার আক্রান্তদের হিসাব বিবেচনায় নিলে মৃত্যুর এই হার একটু বেশি।
ঢাকা শহরে এবং ঢাকা শহরের বাইরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় কন্ট্রোল রুমের (নিয়ন্ত্রণ কক্ষ) বলেছে, গত শনিবার সকাল আটটা থেকে গতকাল রোববার সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গুতে আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোতে মারা গেছেন ৭ জন এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ৩ জন।
সব মিলিয়ে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৩১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে। একটি নির্দিষ্ট বছরে ডেঙ্গুতে এত বেশি মানুষের মৃত্যু এর আগে কখনো বাংলাদেশে হয়নি।
ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা খুবই জরুরি। পর্যালোচনার পর করণীয় ঠিক করা যায় অথবা যে ধারায় কাজ চলছে, তাতে পরিবর্তন এনে মৃত্যু কমানো যায়।বে-নজির আহমেদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
চলতি আগস্ট মাসের প্রথম ছয় দিনেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৬২ জনের। কয়েক দিন ধরে দৈনিক গড়ে ১০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এই রোগে। মৃত্যুর পাশাপাশি ডেঙ্গুর সংক্রমণও থেমে নেই। প্রতিদিনই হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ২ হাজার ৭৬৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যা এ বছর এক দিনে সর্বোচ্চ। এর আগে গত ৩০ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ২ হাজার ৭৩১ জন রোগী। এত দিন এটাই এক দিনে রোগী ভর্তির সর্বোচ্চ সংখ্যা ছিল। চিকিৎসকেরা বলছেন, হাসপাতালে রোগী আসা অব্যাহত থাকলে মৃত্যুও বাড়বে।
এ বছর আক্রান্তের পাশাপাশি ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যুও বাড়ছে। সরকারি হিসাবে, ১৫ বছরের নিচে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪৭টি শিশু মারা গেছে।
কেন এত মৃত্যু
ডেঙ্গুতে মৃত্যু পর্যালোচনার (ডেথ রিভিউ) কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত প্রকাশ করেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যদিও জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা হওয়া উচিত। তাহলে করণীয় নির্ধারণ সহজ হয়।
২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ডেঙ্গুতে মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছিল। দেশের বেশ কয়েকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে একটি কমিটিও করা হয়েছিল। ওই কমিটি কয়েকজনের মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনাও করেছিল।
এ বছর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করতে একটি কমিটি করেছে। এর প্রধান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক আহমেদুল কবীর। গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
গত মাসের প্রথম দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে বলা হয়েছিল, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ৮০ শতাংশ হচ্ছে হাসপাতালে রোগী ভর্তির তিন দিনের মধ্যে। তখন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, পরিস্থিতি বেশি খারাপ হওয়ার পর অনেকে হাসপাতালে আসছেন।
কিছুদিন আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেছেন, এবার ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ‘শক সিনড্রোম’ বেশি দেখা যাচ্ছে।
শক সিনড্রোমের অর্থ রোগীর শরীরে তরল পদার্থ কমে যায়, রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যায় ও রোগীর রক্তচাপ কমে যায়। রোগী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায়।
আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন গত সপ্তাহে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরন। ডেন–১, ডেন–২, ডেন–৩ ও ডেন–৪। এ বছর ডেঙ্গুর দুটি ধরনে ডেন–২ ও ডেন–৩–এ মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল (৬ আগস্ট) পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৬ হাজার ৭৩২ জন। এখন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৯ হাজার ৩৪৭ জন। এ বছর আক্রান্তের পাশাপাশি ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যুও বাড়ছে। সরকারি হিসাবে, ১৫ বছরের নিচে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪৭টি শিশু মারা গেছে।
সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা খুবই জরুরি। রোগী বিলম্বে হাসপাতালে আসার কারণে মৃত্যু হতে পারে, ফ্লুইড ব্যবস্থাপনা (শরীর ও রক্তে তরলের পরিমাণ) ঠিক না হওয়ার কারণে মৃত্যু হতে পারে, অন্য কোনো কারণেও ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হতে পারে। মৃত্যু পর্যালোচনা করলেই কেবল তা জানা যায়।’
বে-নজির আহমেদ বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনার পর করণীয় ঠিক করা যায় অথবা যে ধারায় কাজ চলছে, তাতে পরিবর্তন এনে মৃত্যু কমানো যায়।