ডোনাল্ড লুসহ মার্কিন প্রতিনিধিদল আসছে, অগ্রাধিকার অর্থনৈতিক সহায়তায় 

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ওয়াশিংটন থেকে এটি হবে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের প্রথম সফর।

ব্রেন্ট নেইম্যান ও ডোনাল্ড লু

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে যুক্তরাষ্ট্র আর্থিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার মতো বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। এ নিয়ে আলোচনা করতে এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সফরে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল।

ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়েছে। সূত্রগুলো জানায়, মার্কিন প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে থাকছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও অর্থ দপ্তরের আন্তর্জাতিক অর্থায়নবিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান। প্রতিনিধিদলটি ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও চাহিদার বিষয়টিও জানতে ও বুঝতে চাইবে তারা। এরপর ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বাংলাদেশকে কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, চলতি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশে আসার কথা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধিদলের প্রথম সফর। খুব স্বাভাবিকভাবেই ভবিষ্যতে দুই দেশের সহযোগিতা কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা হবে।

এর আগে আগস্ট মাসে জেনেভা থেকে জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঘিরে নৃশংসতার পাশাপাশি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কারে যুক্ততার বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলটি প্রাথমিক আলোচনার জন্য ঢাকায় এসেছিল।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে গত বছর ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে ঢাকার সঙ্গে ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা ও অস্থিরতা সৃষ্টির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। ৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনার সরকার একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে। তবে গণতন্ত্র আর মানবাধিকার নিয়ে মতপার্থক্যের পরও সম্পর্ক এগিয়ে নিতে মনোযোগী ছিল দুই পক্ষ। এ জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বার্তা দিয়েছিল বাইডেন প্রশাসন। টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসার আট মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়।

ওয়াশিংটন ও ঢাকায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারির মতো এবারও ঢাকা সফরকারী দলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, পররাষ্ট্র দপ্তর, বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার প্রতিনিধিরা থাকছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের জ্যেষ্ঠ পরিচালক লিন্ডসে ফোর্ড, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। মে মাসের পর এটি চলতি বছরে ডোনাল্ড লুর দ্বিতীয় ঢাকা সফর।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পাশাপাশি অর্থ উপদেস্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে। এ নিয়ে গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের আলোচনা হয়েছে।

সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বৈঠকের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলটি ঢাকায় ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের নেতা, রাজনৈতিক দলের নেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সফরে অর্থনৈতিক ও আর্থিক সহায়তার মতো বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার থাকলেও সম্পর্কের নানা দিক আলোচনায় আসতে পারে। ওয়াশিংটন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাদের সমর্থনের কারণে নমনীয় মনোভাব দেখাবে, সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। তবে আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশের উন্নতি, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ ফেরত নিতে না পারা, বকেয়া পরিশোধে জটিলতার মতো বিষয়গুলোও সামনে আসতে পারে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার বিষয়টি তুলে ধরার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের।

নজর হারাবে না শ্রম অধিকার

দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ কয়েক বছর ধরে গুরুত্বে থাকছে বাংলাদেশের শ্রম অধিকারের বিষয়টি। শ্রম আইন সংশোধনের অগ্রগতি হলেও সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতির উন্নতিতে কিছু ঘাটতি এখনো রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতির উন্নয়নে ১১ দফা সুপারিশ করেছিল। কিন্তু পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন না হওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিনিয়োগ ও আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বারবার শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়নে তাগিদ দিয়েছিল।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মার্কিন প্রতিনিধিদলের আসন্ন সফরে শ্রম অধিকারের বিষয়টি কীভাবে আসতে পারে, জানতে চাইলে এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে শ্রম পরিস্থিতি সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকে। তাদের কাছে এটা আর্থিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগের অন্যতম পূর্বশর্ত। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বিষয়টি চাপ হিসেবে না আসার সম্ভাবনা বেশি।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অর্থায়ন সংস্থার (ডিএফসি) কাছ থেকে বাংলাদেশের সহায়তার বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে এবার মার্কিন প্রতিনিধিদলটি ডিএফসির মতো প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তার ক্ষেত্রে শ্রম অধিকারের বিষয়টি সামনে আনতে পারে।

মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক সংস্কার

যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটদের শাসনামলে পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম গুরুত্ব থাকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর। তাই গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকারের বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের আলোচনায় আসাটা স্বাভাবিক। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এ বিষয়গুলোতে জোর দেবে না বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মত।

মানবাধিকারের ক্ষেত্রে গত এক যুগের বেশি সময়জুড়ে বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে সমালোচনা ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সই করেছে। গুমের ঘটনাগুলোর বিচারে তদন্ত কমিশনও গঠন করেছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বরং মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক সংস্কারে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পেতে পারে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে দেশের সংস্কারপ্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের সহায়তা নিয়ে আলোচনা করছে। সংস্কারপ্রক্রিয়ায় সরকারের অগ্রাধিকারের খাতগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের কোথায় কোথায় সহযোগিতার সুযোগ আছে, সেটা নিয়েও আলোচনা হতে পারে।

জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের অগ্রাধিকার আর্থিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের অর্থনীতি একটা জটিল পর্যায়ে রয়েছে। এতে জরুরি ভিত্তিতে আমাদের সহায়তা প্রয়োজন। এখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ডিএফসি থেকে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে চায়। এই সহায়তার জন্য শ্রম পরিস্থিতির উন্নতি প্রয়োজন। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে বিনিয়োগের বিষয় আছে। ফলে মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফরে এসব বিষয় যে প্রাধান্য পাবে, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।’