শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
৮০ কোটি টাকা দিয়ে বানানো দুটি হল খালি, শিক্ষার্থীরা গণরুমে
বঙ্গবন্ধুর মা ও বাবার নামে ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি হল তৈরি করা হয়েছে। জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
বড় একটি কক্ষ। মেঝেতে একটির পর একটি বিছানা। পড়ার টেবিল-চেয়ার তো দূরের কথা, পা ফেলার জায়গাই নেই। দিনের বেলায়ও মশারি টানানো। দেয়ালে পেরেক মেরে টানানো রশিতে ঝুলছে জামাকাপড়। এরই মধ্যে কেউ পড়ছেন, কেউ অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছেন।
রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজ-উদ-দৌলা হলের একটি গণরুমের চিত্র এটি। কক্ষটিতে ১২০ জনের মতো শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে থাকেন। তাঁদের একজন আল শাহরিয়ার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গণরুমে থেকে তিনি এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। সেখানে পড়াশোনার কোনো পরিবেশ নেই। নিরাপত্তা নেই। কক্ষটি অপরিচ্ছন্নও।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হল নেই, তা নয়। শিক্ষার্থীদের জন্য সেখানে ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি নতুন হল নির্মাণ করা হয়েছে। একটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে এক বছর আগে, অন্যটির ছয় মাস আগে। শুধু জনবল নিয়োগ করতে না পারায় শিক্ষার্থীদের হল দুটিতে ওঠানো হচ্ছে না। তাঁদের থাকতে হচ্ছে গণরুমে।
আগে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা জনবল নিয়োগ নিয়ে কাজ করেননি। এ কারণে ভবন হয়ে গেলেও হল চালু করতে পারছি না।শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া, উপাচার্য, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কবে হল দুটিতে শিক্ষার্থীদের ওঠানো হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। জনবল নিয়োগও দীর্ঘসূত্রতার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা জনবল নিয়োগ নিয়ে কাজ করেননি। এ কারণে ভবন হয়ে গেলেও হল চালু করতে পারছি না।’
অবশ্য শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দুই বছর আগে উপাচার্য পদে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছে জনবল চাওয়া হয়েছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে জনবল পাওয়া গেলে তখন হল খুলে দেওয়া সম্ভব হবে।
বর্তমান উপাচার্যের অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য কামাল উদ্দিন আহম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা। উনি (বর্তমান উপাচার্য) তো দুই বছর ধরে দায়িত্বে আছেন। এ সময় কী করেছেন?’ তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অতিরিক্ত জনবল রয়েছে। চাইলেই তাদের নতুন হলে দায়িত্ব দেওয়া যায়।
এটা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা। উনি (বর্তমান উপাচার্য) তো দুই বছর ধরে দায়িত্বে আছেন। এ সময় কী করেছেন?কামাল উদ্দিন আহম্মদ, সাবেক উপাচার্য, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত। ১৯৩৮ সালে দ্য বেঙ্গল অ্যাগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয় ২০০১ সালে। প্রায় ৮৭ একর জমির ওপর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে চার হাজারের মতো। নতুন দুটি বাদে হল আছে পাঁচটি। তিনটি ছাত্রদের, দুটি ছাত্রীদের। ছেলেদের হলগুলোতে একাধিক গণরুম রয়েছে। প্রতিটিতে শতাধিক শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে থাকেন।
আবাসন–সংকট দূর করতে শেরেবাংলা
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় দুটি হল নির্মাণ করা হয়। একটির ব্যয় ৩৯ কোটি টাকা, অন্যটির ৪১ কোটি টাকা। হল দুটির নামকরণ করা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুনের নামে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে হল দুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য কামাল উদ্দিন আহম্মদ। ছাত্রদের জন্য নির্মাণ করা হলের নির্মাণকাজ গত বছরের ডিসেম্বরে শেষ হয়। ছাত্রীদের হলটির নির্মাণকাজ শেষ হয় গত জুনে।
শেখ লুৎফর রহমান হলে ২৫০টি ও সায়েরা খাতুন হলে ২৩৮টি কক্ষ রয়েছে। প্রতি কক্ষে চারটি আসন। মোট আসন ১ হাজার ৯৫২টি। মানে হলো, হল দুটি চালু হলে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের আবাসন–সংকট থাকবে না। এখনকার পাঁচটি হলে সাড়ে তিন হাজারের মতো আসন রয়েছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, নামমাত্র খরচে থাকা যায় বলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরাই মূলত গণরুমে গাদাগাদি করে থাকেন। অনেক শিক্ষার্থী আসেন নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে। তাঁদের পক্ষে ঢাকায় বাসা নিয়ে থাকার সামর্থ্য নেই।
হল চালু হচ্ছে না কেন
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হল দুটি নির্মাণে যতটা উৎসাহী ছিল, চালু করতে সেই উৎসাহ নেই। এ কারণে নির্মাণকাজের সঙ্গে জনবল নিয়োগের কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হয়নি। যেকোনো হল পরিচালনা করতে গেলে প্রশাসনিক কর্মী, নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, রাঁধুনি, খাবার পরিবেশনকারী (ডাইনিং বয়) ইত্যাদি পদে জনবল প্রয়োজন। প্রাধ্যক্ষ ও হাউস টিউটর শিক্ষকদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া যায়।
হল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দায়িত্ব হচ্ছে হলের নির্মাণকাজ শেষ করা। আমার কাজ শেষ। জনবল দেখার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।’
শেখ লুৎফর রহমান হলের ভেতরে গিয়ে ১২ ডিসেম্বর দেখা যায়, প্রতিটি কক্ষে চারটি আলাদা খাট; চারটি পড়ার টেবিল ও চেয়ার এবং চারটি আলমারি রয়েছে। আসবাবের ওপর ধুলাবালুর আস্তরণ তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, শেখ লুৎফর রহমান হল থেকে কয়েক মাস আগে গোসলখানার সামগ্রী, বৈদ্যুতিক বাতিসহ বিভিন্ন উপকরণ ও সরঞ্জাম চুরি হয়। এতে প্রায় চার লাখ টাকা ক্ষতি হয়।
শেখ লুৎফর রহমান হলের নির্মাণকাজ করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিনিময় কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হল বুঝে নিচ্ছে না। যে কারণে আমরা ক্ষতির মুখে পড়েছি। কারণ, নিজেদের টাকা খরচ করে হল দেখভালের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।’
‘আমরা মানবেতর পরিবেশে’
সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার তৈরি ভবন ও অন্য অবকাঠামো অবব্যহৃত থাকার চিত্র সামনে আসছে। সেই তালিকায় নতুন যুক্ত হলো শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যে গণরুমে থাকি, সেটা থেকেই নতুন হল দেখা যায়। আমরা এখানে মানবেতর পরিবেশে থাকি আর হলটি মাসের পর মাস খালি পড়ে আছে।’ তিনি বলেন, প্রশাসনের ন্যূনতম দায়িত্ববোধ থাকলে নতুন হল দুটি এত দিনে চালু হয়ে যেত।