প্রিপেইড মিটার ক্রয়
বিপুর ‘ভাই-বন্ধু’দের স্বার্থে দরপত্রে বিশেষ শর্ত
আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণ ঠেকানোর কৌশল হিসেবে একটি দরপত্রে ‘স্মার্ট প্রিপেইড’ শব্দ যোগ করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ‘ভাই-বন্ধু’দের নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দেওয়ার দাবি উঠেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুতে প্রিপেইড মিটার–বাণিজ্যের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের (বিপু) ‘ভাই-বন্ধু’ নামে পরিচিত একটি চক্রের কাছে। সেই একই চক্রকে এখন আরও প্রায় ১৫ লাখ মিটার সরবরাহের কাজ দিতে সক্রিয় সরকারের বিদ্যুৎ সরবরাহকারী দুটি কোম্পানি। এ জন্য দরপত্রে এমন শর্ত যুক্ত করা হয়েছে, যাতে ওই নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানই সুবিধা পায়।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান নর্দান ইলেকট্রিসিটি পাওয়ার কোম্পানির (নেসকো) জন্য ৮ লাখ মিটার কিনতে গত জুলাইয়ে দরপত্র আহ্বান করা হয়।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ক্ষমতাচ্যুত আ.লীগ সরকারের আমলে মিটার সরবরাহের সঙ্গে ঘুরেফিরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জড়িত ছিল।
প্রায় একই সময়ে ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ৭ লাখ মিটার ও সিস্টেম কেনার জন্য কয়েকটি প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করে। ইতিমধ্যে একটি প্যাকেজে ১ লাখ ৩৯ হাজার মিটার কেনার দরপত্র এখন যাচাই–বাছাই পর্যায়ে রয়েছে। আরেকটি প্যাকেজে ৫১ হাজার মিটার ক্রয়ের দরপত্রের প্রক্রিয়া চলমান। এর মধ্যে একটিতে হেক্সিং, ইনহে মিটার, শেনজেন স্টার, ওয়াসিওন ও হোলি মিটার নামের প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এই পাঁচ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটিই সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ভাই-বন্ধুদের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। প্যাকেজ–১–এর দরপত্র দলিলের শর্ত অনুযায়ী, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে গত পাঁচ বছরে সমজাতীয় মিটার স্থাপনে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের সনদ থাকতে হবে। ন্যূনতম ৫০ হাজার স্মার্ট প্রিপেইড মিটার পাওয়ার লাইন কমিউনিকেশন (পিএলসি) স্থাপনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এটি একটি আন্তর্জাতিক দরপত্র। সেখানে ‘স্মার্ট প্রিপেইড’ শব্দ যোগ করা হয়। এ খাতের আন্তর্জাতিক বড় কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণ ঠেকানোর কৌশল হিসেবে এমন শর্ত যুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। ফলে বিগত সময়ে যারা ওয়েস্ট জোনে মিটার সরবরাহ করেছে, তারাই সুবিধা পেতে যাচ্ছে।
এ দরপত্রে পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে বলে জানান ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সদ্য বিদায়ী নির্বাহী পরিচালক শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা চেয়েছি নতুন নতুন কোম্পানি দরপত্রে অংশ নিক। যদি কোনো সমস্যা হয়, তাহলে দরপত্র বাতিল করার সুযোগ আছে।’
বিগত সময়ে মিটার সরবরাহের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মিটার সরবরাহের সঙ্গে ঘুরেফিরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে দেখা যেত। সেগুলোর মধ্যে শেনজেন স্টার ও ওয়াসিওন অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠানের এদেশীয় প্রতিনিধি সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ভাই-বন্ধু হিসেবে পরিচিত।
নেসকোর তথ্য বলছে, গত জুলাইয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে নতুন করে যে ৮ লাখ মিটার কেনার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল, তাতে অভিজ্ঞতা হিসেবে শর্ত দেওয়া হয়, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে গত সাত বছরে প্রতিষ্ঠিত কোনো বিদ্যুৎ কোম্পানিতে সমজাতীয় তিনটি মিটার স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়নের সনদ থাকতে হবে। অথবা গত সাত বছরে অন্তত একটি প্রকল্পে ৩ লাখ মিটার সরবরাহ প্রমাণ করতে হবে। এ ছাড়া নেসকোর চলমান সিস্টেমের সঙ্গে ইন্টিগ্রেশনের একটি রিজেকশন শর্ত উল্লেখ করা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ইন্টিগ্রেশনের ক্ষেত্রে নেসকো এবং বিদ্যমান সিস্টেম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান শেনজেন স্টার ও ওয়াসিওনের অসহযোগিতার কারণে কোনো দরদাতা প্রতিষ্ঠানই ইন্টিগ্রেশন শেষ করতে পারেনি। তাই নেসকোতে বিদ্যমান মিটার সরবরাহকারী শেনজেন স্টার ও ওয়াসিওন ছাড়া অন্য কোনো দরদাতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কারিগরিভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলের মিটার প্রকল্পগুলোর মতো নেসকোতে চলমান দুটি প্রকল্পে ৮ লাখ মিটার সরবরাহের কাজ শেনজেন স্টার ও ওয়াসিওনকে দেওয়ার রূপরেখা নির্ধারণ করেই দরপত্রের আয়োজন করা হয়েছে, যা বর্তমানে যাচাইপ্রক্রিয়া শুরু করার জন্য বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিদ্যুৎ খাতের এ ধরনের সব প্রকল্পের কাজ পেয়েছেন সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ঘনিষ্ঠজনেরা। তাঁদের স্বার্থেই এই শর্ত যুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নেসকোর এবারের দরপত্রে যে সাত প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আগের প্রকল্পে কাজ পাওয়া সেই ভাই–বন্ধু চক্র সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে।
নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সাতটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিয়েছে। এখনো দরপত্র মূল্যায়ন শুরু হয়নি। এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কারণে দরপত্র কার্যক্রম স্থগিত আছে। তিনি বলেন, নেসকোর মাধ্যমে প্রিপেইড মিটার বসানোর পক্ষে নন তিনি। কারণ, এতে বিতর্ক তৈরি হয়। উন্মুক্ত বাজারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গ্রাহকেরা মিটার কিনলে এ বিতর্ক থাকবে না বলে মত দেন জাকিউল ইসলাম।
নেসকোর তথ্য বলছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে দুটি প্রকল্পের আওতায় সাতটি দরপত্রের মাধ্যমে সাড়ে ১৪ লাখ মিটার কিনেছে নেসকো। এর মধ্যে চারটি দরপত্রে ৫৫০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে চীনের শেনজেন স্টার আর তিনটিতে ৪৫০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে ওয়াসিওন।
জানা গেছে, শেনজেন স্টারের বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিনিধি (এজেন্ট) ছিলেন নসরুল হামিদের স্ত্রীর বড় ভাই প্রয়াত মোহাম্মদ সুজাত ইসলাম। করোনা মহামারির সময় তাঁর মৃত্যুর পর এ দায়িত্ব নেন তাঁর নিকটাত্মীয় মাহবুব রহমান। ওয়াসিওনের সঙ্গে দুটি দরপত্রে ছিল টেকনো ইলেকট্রিক্যাল ও একটিতে ছিল এসকিউ ট্রেডিং। এই দুটি কোম্পানি এসকিউ গ্রুপের, যার মালিকানায় আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আবু জাফর মো. শফিউদ্দিন ওরফে শামীম। ওয়াসিওনের স্থানীয় প্রতিনিধি হলো এসকিউ।
এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মিটার–বাণিজ্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ভাই–বন্ধুদের নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দেওয়ার দাবি উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানও বলেছেন, দরপত্রে নির্বাচিত ঠিকাদার নন, তাঁরা সবার অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে চান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে যদি দরপত্রে বিশেষ কোনো শর্ত দেখা যায়, তাহলে তা বাতিল করা হবে। বর্তমান সরকারের নীতি হচ্ছে, দরপত্র এমনভাবে ডাকা, যেখানে সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।