রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন, তা আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে না হলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সমাবেশ থেকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য মাহিন সরকারের আহ্বানে আজ মঙ্গলবার দুপুরে এ সমাবেশ হয়। সেখানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নাম পরিবর্তন করে বাহিনীটিকে আগের বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) নামে ফিরিয়ে আনার দাবিও জানানো হয়।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডে নিহত ও কারাগারে বন্দী কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা এতে যোগ দেন। চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারাও সমাবেশে বক্তব্য দেন।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর গঠিত জাতীয় তদন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. হাসান নাসির। সমাবেশে যোগ দিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রতিবেদনে বাদ দেওয়ায় আমি তদন্ত ঠিক হয়নি মর্মে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্ন মন্তব্য) দিয়ে স্বাক্ষর করি। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও একটা নামমাত্র তদন্ত হয়। ...বাস্তবে হত্যার প্রকৃত পরিকল্পনাকারীদের ধরার ব্যাপারে কোনো প্রচেষ্টা নেওয়া হয়নি।’
হাসান নাসির বলেন, ‘যাঁদের জেলে নেওয়া হয়, তাঁদের অনেকেই নিরীহ ছিলেন। ভুয়া বিচারেও তাঁদের অনেকেই নিরপরাধ প্রমাণিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা জেলে আছেন। ...যাদের ব্যর্থতায় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যারা পরিকল্পনা করেছিল, যে ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছিল, তার তৎকালীন অধিনায়কসহ সব অফিসার-সংস্থাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
সমাবেশে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান বীর প্রতীক বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনা নিজে জড়িত ছিলেন। তাঁর আশপাশের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরাও জড়িত ছিলেন। বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে জরুরি ভিত্তিতে আমলা ছাড়া নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশনের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করতে হবে। মানবাধিকারকর্মী, সেনা কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও ছাত্র-প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিশন গঠন করতে হবে। তদন্ত হতে হবে প্রকাশ্যে, লুকোচুরির কিছু নেই।
হাসিনুর রহমান আরও বলেন, বিজিবির নাম পরিবর্তন করে আগের নাম বিডিআরে ফিরিয়ে নিতে হবে।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) ফেরদৌস আজিজ বলেন, বিডিআর হত্যার তদন্ত কমিশন অতি দ্রুত গঠন করা হোক। এই কমিটি নিয়ে আর কোনো টালবাহানা চলবে না।
২০১৩ সালে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট ইমরান কাজল বলেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহ শব্দটি পরিত্যাগ করতে হবে। এটা পিলখানা হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডসহ সব সীমান্ত হত্যার বিচার আমরা চাই।’
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম দফায় চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মো. শামসুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের পরও শত শত কর্মকর্তা চাকরি হারিয়েছেন বিভিন্ন অজুহাতে, জেলে গিয়েছেন এবং হত্যাকাণ্ড ও গুমের শিকার হয়েছেন। আমরা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বিদায়ের জন্য অপেক্ষা করেছি, যাতে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ বিচার পাওয়া যায়। সেই দিন এলেও অন্তর্বর্তী সরকার এটা নিয়ে টালবাহানা শুরু করেছে।’
পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত সাবেক বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া তাঁর বক্তব্যের শুরুতে বলেন, ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ড শুধু সেনাবাহিনী ও রাইফেলসকে নয়, দেশের সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এ হত্যার বিচার কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না বলে আমার বিশ্বাস।’
পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত মেজর তানভীর হায়দার নূরের স্ত্রী তাসনুভা মাহা নিহত সেনা কর্মকর্তা ও জওয়ানদের পরিবার যেন ন্যায়বিচার পায়, সেই আকুতি জানান। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীর লাশ পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গত চার মাসে বারবার চেষ্টা করেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাইনি। ...২০০৯ সালের ৩ মার্চ আমি বলেছিলাম, পিলখানায় যারা আমাকে ধরে নিয়ে বন্দী করেছিল, তাদের মধ্যে তিনজন হিন্দি ভাষা বলছিল। এ জন্য এ পর্যন্ত আমি অনেক অপমানের শিকার হয়েছি, কোনো জায়গায় আমাকে চাকরি করতে দেওয়া হয়নি।’
হত্যা মামলায় খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলায় এখনো কারাগারে থাকা এক বিডিআর সদস্যের ছেলে শাকিল বলেন, অবিলম্বে বিডিআর জওয়ানদের মুক্তি দিতে হবে এবং স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
সমাবেশে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য মাহিন সরকার। তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আজ সংবাদ সম্মেলনে পাঁচ দিনের মধ্যে কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা তাঁকে পাঁচ দিন সময় দেওয়ার পক্ষে। কিন্তু যদি পাঁচ দিনের মধ্যে জাতির সামনে এই কমিশন প্রকাশ না করা হয় ও সেখানে যদি কোনো দল থাকে, তাহলে ষষ্ঠ দিনে আমাদের রাজপথে দেখা হবে।’
মাহিন সরকার ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যকে কমিশনের সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ছাত্র প্রতিনিধি রাখার দাবি জানান। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে তাঁদের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সমাবেশে সাবেক সেনাসদস্য ও মানবাধিকারকর্মী খান সাহেব আমানউল্লাহ, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আবু সাঈদ লিওন প্রমুখ বক্তব্য দেন।
‘সাধারণ বিডিআর পরিবার’ ব্যানার নিয়ে একদল ব্যক্তি এ সমাবেশে এসেছিলেন। ব্যানারে লেখা ছিল, ‘শেখ হাসিনার প্রহসনমূলক বিডিআর হত্যা মামলা, বিস্ফোরক মামলা ও প্রহসনমূলক রায় বাতিল, কারাগারে থাকা বিডিআর সদস্যদের অবিলম্বে কারামুক্তি, চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের চাকরি পুনর্বহাল, বিডিআর হত্যা মামলার পুনঃ তদন্ত ও ন্যায়বিচার করা হোক’।
এর আগে আজ সকালে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।