সৎ ও যোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে

‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: জনপ্রশাসন প্রসঙ্গ’ শীর্ষক সংলাপে আলোচকেরা। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনেছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

জনপ্রশাসনের বড় চ্যালেঞ্জ হলো দলীয়করণ। রাজনীতিবিদ ও আমলারা মিলেই জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ করেছেন। জনমুখী হওয়ার পরিবর্তে জনপ্রশাসন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সার্বিকভাবে জনপ্রশাসনের পুরো ব্যবস্থাটি দাঁড়িয়ে আছে একটি দালাল ব্যবস্থার (ব্রোকার সিস্টেম) ওপর। এ জন্য এ খাতের সংস্কার করতে হবে। এতে স্থানীয় সরকারকে প্রাধান্য দেওয়া, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করে জবাবদিহির আওতায় আনাসহ জনমুখী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: জনপ্রশাসন প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক সংলাপে এ কথাগুলো বলেছেন আলোচকেরা। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এই সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা বক্তব্য দেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, জনপ্রশাসনে বড় ধরনের তিনটি ঘাটতি রয়েছে। একটি হলো সার্বিকভাবে জনপ্রশাসনের পুরো ব্যবস্থাটি দাঁড়িয়ে আছে একটি দালাল ব্যবস্থার (ব্রোকার সিস্টেম) ওপর। বড় ফাইল বলেন অথবা হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, সেখানে দালালের একটি বড় ধরনের বাস্তবতা। সত্যিকার অর্থে ভালো সংস্কার করতে চাইলে এর মূলে আঘাত হানা জরুরি। আরেকটি হলো মেধার অপচয়। প্রশিক্ষণ নেওয়া হলো মৎস্য চাষ কীভাবে ভালো করতে হয় তা নিয়ে, কিন্তু তারপরেই ধর্ম মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হলো। এটি একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা। মেধা আছে কিন্তু এটির অপচয়ের বড় ধরনের প্রবণতা জনপ্রশাসনে। সংস্কারের চিন্তা করা হলে এই মৌলিক ব্যবস্থায় আঘাত আনা দরকার।

তদবির সংস্কৃতিকে জনপ্রশাসনের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও এই তদবিরের বাইরে নয়। গত চার মাসে যেসব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার অনেক নিয়োগ প্রশ্নবোধক, ত্রুটি আছে। তারা বিচার–বিশ্লেষণ করে নিয়োগ দিতে পারেনি। তাদেরও অনেক ভুলভ্রান্তি হয়েছে।

আরেকটি সমস্যার কথা বলতে গিয়ে হোসেন জিল্লুর বলেন, কার্যকর জনপ্রশাসন তৈরি করতে হলে স্থানীয় সরকারের আলোচনা ছাড়া এই আলোচনা পূর্ণতা পায় না। স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ কার্যকর জনপ্রশাসন তৈরির অন্যতম পাথেয়। স্থানীয় সরকারকে যদি সঠিকভাবে শক্তিশালী করা যায় এবং সে ধরনের বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়, তাহলে জনপ্রশাসন সংস্কারের অনেক কাজ কমে আসে। বাস্তবতা হলো জাতীয় নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্র মিলে স্থানীয় সরকারকে একটি ছোটখাটো চাকর পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছে। স্থানীয় সরকারকে যদি শক্তিশালী করা না যায়, তাহলে জনপ্রশাসন সংস্কারও পূর্ণতা পাবে না।

‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: জনপ্রশাসন প্রসঙ্গ’ শীর্ষক সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশল, জনপ্রশাসন ইত্যাদি পেশাজীবী অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রমের সমালোচনা করে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অঙ্গসংগঠন থাকতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো অঙ্গসংগঠনগুলো দলীয়করণ ও দলীয় চাপ তৈরির অন্যতম বাহন হিসেব কাজ করছে। ফলে স্বাস্থ্য খাতকে ঠিক করতে চান, সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াবে এই অঙ্গসংগঠন; শিক্ষা খাতকে ঠিক করতে চাইবেন, অঙ্গসংগঠন বাধা হয়ে দাঁড়াবে। প্রকৌশল, ব্যাংকিং ইত্যাদি ইত্যাদি। অঙ্গসংগঠনের বিষয়টি এই অলোচনায় (সংস্কারের আলোচনায়) আনা দরকার। এটির দায়িত্ব বর্তাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। এ জন্য তাদের সঙ্গে আলোচনা জরুরি।

বাস্তবতা হলো জাতীয় নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্র মিলে স্থানীয় সরকারকে একটি ছোটখাটো চাকর পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছে। স্থানীয় সরকারকে যদি শক্তিশালী করা না যায়, তাহলে জনপ্রশাসন সংস্কারও পূর্ণতা পাবে না।
হোসেন জিল্লুর রহমান, অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

দাবিদাওয়া নিয়ে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের আন্দোলনের বিষয়ে প্রশ্ন রেখে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এটা কি জনস্বার্থে নাকি কোটারি স্বার্থে, সেই প্রশ্ন আজ জনগণের করার সময় এসেছে।

সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ছয়টি সংস্কার কমিশন শিগগিরই তাদের প্রস্তাব দেবে। এরপর কিন্তু বলটি অন্যদের কোর্টে। একটি সরকারের কোর্টে, আরেকটি রাজনৈতিক দলের কোর্টে। আরেকটি আবার নাগরিকদের কোর্টে। তবে নির্বাচনের বিষয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হলো নির্বাচন কমিশন। বলটি হবে তাদের কোর্টেও। তারা কীভাবে খেলবে, তার ওপর নির্ভর করবে কী রকম ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।

গণতন্ত্রের জন্য যত কিছু করা হোক না কেন, প্রশাসন যদি ঠিক না থাকে তাহলে সেটি কার্যকর করা কঠিন বলে উল্লেখ করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ। তিনি বলেন, ধারাবাহিকভাবে যেটি চলে এসেছে সেটি হলো প্রশাসন একধরনরে দালালি অর্থাৎ ক্ষমতায় যারা থাকে তাদের প্রতি...।

গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের কাজে সেভাবে জনপ্রশাসনকে গড়ে তুলতে চাইলে কয়েকটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেন সাবেক এই আমলা। তিনি বলেন, প্রথমত সবার মানসিকতা অর্থাৎ মনোভঙ্গির সংস্কার বা পরিবর্তন হতে হবে। প্রশাসন প্রচণ্ডভাবে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। ফলে পাবলিক সার্ভেন্ট বললেও আসলে কিন্তু হয়নি, আসলে মালিক হয়েছে। আবার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় করা হয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্যকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। সংস্কার করে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে মত দেন তিনি।

সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত আমলাতন্ত্রের ইতিহাস তুলে ধরেন। স্বাধীনতার পর থেকেই দলীয়করণ ও নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে আমলাতন্ত্রকে একেবারে দলীয়করণ করা হয়েছে। এ জন্য দুই পক্ষই দায়ী। রাজনীতিবিদেরা প্রধানত দায়ী, আমলারাও দায়ী। কারণ, আমলারা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে রাজনীতিবিদদের কাছে গিয়ে ধরা দিলেন। দলীয়করণের ফলে অনৈতিক, অন্যায় ও অন্যায্যভাবে পদ-পদবি দখলের একটি প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। কেউ বিবেক দিয়ে প্রশ্ন করে না যে সে পদটি তাঁর পাওনা কি না।

‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: জনপ্রশাসন প্রসঙ্গ’ শীর্ষক সংলাপে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

তদবির সংস্কৃতিকে জনপ্রশাসনের জন্য আরেকটি বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও এই তদবিরের বাইরে নয়। গত চার মাসে যেসব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার অনেক নিয়োগ প্রশ্নবোধক, ত্রুটি আছে। তারা বিচার–বিশ্লেষণ করে নিয়োগ দিতে পারেনি। তাদেরও অনেক ভুলভ্রান্তি হয়েছে।

আমলাতন্ত্রকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে সাবেক সচিব আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, যোগ্য ও সৎ লোকদের বাছাই করে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করেন। একই সঙ্গে জবাবদিহির আওতায় আনেন। তাহলে দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে।

জনপ্রশাসন জনবিচ্ছিন্ন প্রশাসনে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন। তিনি বলেন, এটিকে জনমুখী করতে হবে।

আয়োজক প্রতিষ্ঠান সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় সংলাপে আরও অংশ নেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও সাবেক সংসদ সদস্য মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব, নৈতিক সমাজ বাংলাদেশের সংগঠক মেজর জেনারেল (অব.) আমসা আমিন, তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বর্তমানে বিজিবি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন আহমেদ, সিজিএসের চেয়ার মুনিরা খান, সাবেক সচিব ইব্রাহিম খান ও সুলতানা আফরোজ, অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, দৈনিক যুগান্তরের সহকারী সম্পাদক মাহবুব কামাল, এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিভ মুভমেন্টের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তাহমিদ আল মুদাসসির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ইফফাহ আসসারিয়া প্রমুখ।