এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার। ভালো ফল করায় অনেক পরিবার আনন্দে ভাসছে। কিন্তু আনন্দের এই খবরে কিছু পরিবারে নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া। পরিবারগুলোতে পড়েছে কান্নার রোল। মা-বাবার আহাজারি কিছুতেই থামছে না। কারণ, খবরটি পাওয়ার অনেক আগেই তাঁদের আদরের সন্তান এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিহত হয়েছেন তাঁরা। বাবা-মায়েরা বলছেন, তাঁদের সন্তানই বেঁচে নেই, এখন ফল দিয়ে কী করবেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সাভারের নাফিসা হোসেন মারওয়া, ময়মনসিংহের শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন, লক্ষ্মীপুরের সাদ আল আফনান, সিরাজগঞ্জের সিহাব হোসেন ও নোয়াখালীর মো. রায়হান নিহত হন। তাঁদের সবাই গুলিতে নিহত হয়েছিলেন।
অধরাই রয়ে গেল নাফিসার স্বপ্ন
গত বছরের শেষ দিকে বাবা আবুল হোসেন নাফিসাকে টঙ্গীর সাহাজউদ্দিন সরকার আদর্শ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। কিন্তু নাফিসা বেশির ভাগ সময় থাকতেন সাভারে, মামা হযরত আলীর বাসায়। সেখান থেকেই ছাত্র আন্দোলনে নিয়মিত যোগ দিতেন। গত ৫ আগস্ট সকালে মামাকে জানিয়েছিলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গাবতলী যাবেন তিনি। দুপুরের পর সাভার মডেল মসজিদ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান নাফিসা। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মা কুয়েত গিয়েছিলেন।
প্রবাসে বসেই মেয়ের মৃত্যুর খবর পান। এর পরপরই চলে আসেন দেশে। গতকাল শুনলেন, তাঁর মেয়ে জিপিএ-৪.২৫ পেয়েছেন। টঙ্গীর সাহাজউদ্দিন সরকার আদর্শ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলেন নাফিসা।
মা কুলসুম বেগমের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয় গতকাল। আক্ষেপ ঝরে তাঁর কণ্ঠে, মেয়ের স্বপ্ন পূরণ হলো না। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘গ্রাফিক ডিজাইনার ও ফটোগ্রাফার হওয়ার শখ ছিল নাফিসার। আজকে (মঙ্গলবার) রেজাল্ট দিছে। কিন্তু সেই রেজাল্ট দেখার মানুষটাই তো নাই। ওর স্বপ্ন পূরণের জন্য বিদেশে গেলাম। আর সে-ই আমাদের ছেড়ে চলে গেল।’
নাফিসার স্মরণে সাভারের দক্ষিণ বক্তারপুরে কোর্টবাড়ি এলাকার একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ নাফিসা সড়ক’।
শাহরিয়ারের জন্য বাবার আক্ষেপ
শাহরিয়ার ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ পৌর এলাকার আইডিয়াল কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৪.৮৩ পেয়েছেন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন শাহরিয়ার। গত ১৮ জুলাই বিকেলে ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরের কাছে গুলিবিদ্ধ হন। গুলি ডান চোখের পাশ দিয়ে ঢুকে মাথা ভেদ করে বের হয়ে যায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ জুলাই মারা যান শাহরিয়ার।
তাঁদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের কুমড়াশাসন উত্তর পাড়া গ্রামে। ওই গ্রামের শেখ আবদুল মতিন ও মা মমতাজ বেগমের একমাত্র ছেলে ছিলেন তিনি। মতিন ও মমতাজ দম্পতি থাকেন ঢাকার কুড়িল কুড়াতলী বাজার এলাকায়। শাহরিয়ার ঈশ্বরগঞ্জে থেকে পড়াশোনা করতেন। গত ১০ জুলাই ঢাকায় এসে মিরপুরে খালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
শেখ আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সন্তান নিয়ে মা-বাবার অনেক স্বপ্ন থাকে। কিন্তু আমার সবই শেষ। ছেলে তার ফল দেখে যেতে পারেনি। এর চেয়ে কষ্টের কী হতে পারে। সারা জীবন এই কষ্ট বয়ে বেড়াতে হবে।’
আফনানও মাকে ছেড়ে চলে গেলেন
আফনান লক্ষ্মীপুর ভিক্টোরি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। জিপিএ-৪.১৭ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁর বাড়ি লক্ষ্মীপুর শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে। তিনি ওই এলাকার মৃত সালেহ আহমেদের ছেলে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ঘিরে ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুর শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেদিন গুলিতে আফনানসহ নিহত হন চার শিক্ষার্থী। নিহত আফনানকে ওই দিন তাঁর মামার বাড়িতে দাফন করা হয়।
আফনানের মা নাছিমা আক্তার বলেন, ‘ছেলের ফলে খুশি। কিন্তু যাকে নিয়ে খুশি উদ্যাপন করব, সে তো আমার কাছে নেই। গুলি করে ছেলেকে মেরে আমার কোল শূন্য করে দিয়েছে। আফনানের মৃত্যুর প্রায় আড়াই মাস পেরিয়ে গেছে। ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে কবরে।’
নাছিমা আক্তার জানান, আফনানের মৃত্যুর দুই মাস আগে স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি। ছেলেকে ঘিরেই ছিল তাঁর জগৎ। ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই ছেলেকেও হারাতে হলো।
মায়েদের প্রশ্ন, ‘এই পাস দিয়ে কী হবে’
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন সিহাব হোসেন। গতকাল প্রকাশিত ফলাফল থেকে জানা যায়, সিহাব সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে জিপিএ-৪.০৮ পেয়ে পাস করেছেন। তিনি বেলকুচি উপজেলার মাধবপুর গ্রামের প্রবাসী শফি মিয়ার বড় ছেলে।
ছেলের ফল শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা শাহনাজ পারভীন। আনন্দের এই দিনে ছেলের জন্য তাঁর বুকে এখন শুধুই হাহাকার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘রেজাল্ট দিয়ে আমরা কী করব? আমি আমার সোনার ছেলেকে কোথায় পাব?’
ঢাকায় ছাত্র-জনতার গুলিতে নিহত মো. রায়হানও এইচএসসি পাস করেছেন। রায়হানের বাড়ি নোয়াখালী সদর উপজেলার নোয়ান্নই ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব দুর্গানগর গ্রামে। তিনি রাজধানীর গুলশান কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।
রায়হানের বাবা মো. মোজাম্মেল হোসেন ঢাকার বাড্ডায় একটি ভবনের কেয়ারটেকার হিসেবে চাকরি করেন। ওই ভবনের পাশেই একটি মেসে থাকতেন রায়হান। ৫ আগস্ট বাড্ডা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। পরিবারের সদস্যরা জানান, জিপিএ-২.৯২ পেয়ে পাস করেছেন রায়হান।
রায়হানের মা আমেনা খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলে বেঁচে নেই, তার এই ফল দিয়ে কী হবে? নিজেরা না খেয়ে সন্তানকে খাইয়েছি। তাকে ঢাকায় পড়ালেখা করিয়েছি। তার অনেক স্বপ্ন ছিল। সব স্বপ্ন বুলেটে শেষ হয়ে গেছে।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]