ডিম, মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যের দাম বাংলাদেশেই বেশি
ঢাকার খুচরা দোকান থেকে এখন এক ডজন (১২টি) ডিম কিনতে লাগছে প্রায় ১৫০ টাকা। এক মাস, দুমাস নয়; বছর দুয়েক ধরে ডিমের দাম চড়া। ফলে প্রাণিজ আমিষের কম খরচের উৎস বলে পরিচিত ডিম কিনতেও মানুষ হিমশিম খাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) একটি সমীক্ষা বলছে, এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চা, মুরগির খাবার ও ডিমের দাম ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। এর কারণ, আমদানি একেবারেই নিয়ন্ত্রিত রেখে ‘অতিমাত্রায়’ সুরক্ষা প্রদান।
বাংলাদেশে ডিম, মুরগির বাচ্চা ও পোলট্রি খাদ্য আমদানিতে আগে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়। তবে অনুমতি সাধারণত পাওয়া যায় না। কেউ আমদানিও করে না।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) একটি সমীক্ষা বলছে, এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চা, মুরগির খাবার ও ডিমের দাম ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। এর কারণ, আমদানি একেবারেই নিয়ন্ত্রিত রেখে ‘অতিমাত্রায়’ সুরক্ষা প্রদান।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, এ সুযোগে চড়া দাম আদায়ের সুযোগ পাচ্ছেন ডিম, মুরগির বাচ্চা ও খাদ্য ব্যবসায়ীরা। অন্য অনেক খাতেই দেশীয় শিল্প যেমন আছে, তেমনি আমদানির সুযোগও আছে। এতে বাজারে ভালো প্রতিযোগিতা আছে। কিন্তু পোলট্রি খাতে কেন আমদানি নিয়ন্ত্রিত, সেই প্রশ্ন উঠছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাজারে দাম কমাতে নির্দিষ্ট শুল্ক আরোপ করে আমদানি উন্মুক্ত করার পক্ষে। তবে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় তা চায় না। দ্রব্যমূল্য নিয়ে সরকারি সংস্থার বিভিন্ন বৈঠকে আমদানির সুযোগ দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এ কারণে বাজারে ডিম, মুরগির মাংস ও গরুর মাংসের দাম কমছে না।
এক বছর আগে যে খাবার ১০০ টাকায় কেনা যেত, তা কিনতে জুনে লেগেছে ১১০ টাকার বেশি।
শুধু ডিম ও মাংস নয়, এখন বেশির ভাগ পণ্যের দামই চড়া। সরকারের জন্য মূল্যস্ফীতি এখন উদ্বেগের বিষয়। দেশে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই অনেক দিন ধরে। গতকাল রোববার প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ। অর্থাৎ, এক বছর আগে যে খাবার ১০০ টাকায় কেনা যেত, তা কিনতে জুনে লেগেছে ১১০ টাকার বেশি।
২০২৩ সালের মার্চে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এক প্রতিবেদন উপস্থাপন করে জানায়, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ৯৬ শতাংশ নিম্নবিত্ত পরিবার মাংস খাওয়া, ৮৮ শতাংশ মাছ খাওয়া এবং ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম খাওয়া কমিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তাদের ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে পণ্যভিত্তিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে হবে। তবে সেটা শুল্ককর আরোপ করে। কিন্তু কোনো পণ্যই আমদানি ‘নিষিদ্ধ’ হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, পোলট্রি খাতে ১৫ শতাংশ সুরক্ষা দেওয়া যেতে পারে। মানে হলো, এমনভাবে আমদানিতে শুল্ককর আরোপ করতে হবে, যাতে ভারত বা পাকিস্তান থেকে আনতে গেলে দাম ১৫ শতাংশ বেশি পড়ে। বাজারে যদি এর চেয়ে দাম বেড়ে যায়, তাহলে আমদানিকারকেরা আমদানি করবেন। এতে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হবে।
উল্লেখ্য, ডিম আমদানিতে এখন সুরক্ষা আছে ৩৩ শতাংশ। পোলট্রি খাদ্যে তা সাড়ে ১৭ শতাংশ। তারপরও আমদানি কার্যত নিষিদ্ধ।
দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে হবে। তবে সেটা শুল্ককর আরোপ করে। কিন্তু কোনো পণ্যই আমদানি ‘নিষিদ্ধ’ হওয়া উচিত নয়।পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর
ভারত ও পাকিস্তানে কত দাম
ট্যারিফ কমিশনের সমীক্ষা প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা করে তৈরি করা হয়েছে। ১ জুলাই অংশীজনদের সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয়।
অংশীজনদের সূত্রে পাওয়া প্রতিবেদনে দেখা যায়, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতে প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১ থেকে ৯৬ টাকা। পাকিস্তানে ছিল ৭৩ থেকে ১১৮ টাকা। বাংলাদেশে ওই সময় ডিম বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকায়। অর্থাৎ, বাংলাদেশে ডিমের দাম ভারতের চেয়ে গড়ে ৭৮ এবং পাকিস্তানের চেয়ে ৬৫ শতাংশ বেশি।
বাজারে এখন ডিমের দাম কিছুটা কমেছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে ঢাকায় এক ডজন ডিমের দাম এখন ১৩৫–১৫০ টাকা। যদিও ২০২২ সালের রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে ডিমের দাম বছরজুড়ে ডজনপ্রতি ৮০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে থাকত।
ডিম উৎপাদনের জন্য খামারিদের এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চা কিনে লালন–পালন করতে হয়। জুনের প্রথম সপ্তাহে ভারতে এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দাম ছিল প্রতিটি ৩৫ থেকে ৫৬ টাকা। পাকিস্তানে ছিল ২১ থেকে ৪২ টাকা। বাংলাদেশে মুরগির বাচ্চার দাম ৫৫ থেকে ৭৪ টাকা। অর্থাৎ, বাংলাদেশে মুরগির বাচ্চার গড় দাম ভারতের চেয়ে ৪২ এবং পাকিস্তানের চেয়ে ১০৫ শতাংশ বেশি।
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতে প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১ থেকে ৯৬ টাকা। পাকিস্তানে ছিল ৭৩ থেকে ১১৮ টাকা। বাংলাদেশে ওই সময় ডিম বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকায়।
পোলট্রি খাবার খাইয়ে খামারে মুরগি পালন করা হয়। ট্যারিফ কমিশনের সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুনের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রতি কেজি মুরগির খাবারের (লেয়ার গ্রোয়ার) দাম ছিল ৫৭ থেকে ৫৯ টাকা। ভারতে ছিল ৩৭–৪৮ টাকা। পাকিস্তানে ছিল ৩৯ থেকে ৪১ টাকা। বাংলাদেশে গড় দাম ভারতের চেয়ে ৩৭ ও পাকিস্তানের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ পোলট্রি ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. আহসানুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, পোলট্রি খাদ্যের মূল উপকরণ ভুট্টা, সয়াবিন ইত্যাদি ভারত ও পাকিস্তান অনেকটাই উৎপাদন করে। বাংলাদেশকে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যয় বেশি। তিনি বলেন, আমদানিতে জাহাজভাড়া ও অগ্রিম আয়কর বাবদ ব্যয়ও আছে।
সরকার পোলট্রি শিল্পকে এগিয়ে নেওয়া এবং ডিম ও মাংস সাশ্রয়ী করতে খাদ্যের উপকরণ আমদানি শুল্কমুক্ত রেখেছে। তাতে মানুষ কতটা সুফল পাচ্ছে, সেই প্রশ্নও রয়েছে।
ট্যারিফ কমিশন দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান থেকে লেয়ার (গ্রোয়ার) মুরগির খাদ্যের ব্যয় বিবরণী সংগ্রহ করেছে। এতে দেখা যায়, এক কেজি খাদ্য উৎপাদনে উপকরণের ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে প্রায় ৪৬ টাকা, যা ভারত ও পাকিস্তানে প্রস্তুতকৃত খাদ্যের বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি।
পোলট্রি খাদ্য আমদানিতে শুল্ককরসহ রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মান মেনে চলার শর্ত। কিন্তু তারপরও আমদানি উন্মুক্ত নয়। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী খাদ্য আমদানিতে বিভিন্ন শর্ত আরোপের পরও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পূর্বানুমতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরকার অতিমাত্রায় সুরক্ষা দেওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে দেশে পোলট্রি খাদ্যের দাম অনেক বেশি বাড়ছে।
কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুরগির ডিম উৎপাদন খরচের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ যায় পোলট্রি খাদ্যের দামের পেছনে। ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে ৮০ লাখ টনের বেশি পোলট্রি, মাছ ও পশুখাদ্যের চাহিদা রয়েছে। বাজারের আকার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এই বাজারে ২০০টির মতো কারখানা গড়ে উঠেছে। যদিও বড় কারখানার সংখ্যা ১০টির মতো। বাজারের হিস্যা তাদেরই বেশি।
বিষয়টি নিয়ে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে দাম ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি হওয়া স্বাভাবিক। তবে এতটা পার্থক্য গ্রহণযোগ্য নয়। কোন স্তরে দাম বাড়ছে, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।
বিশ্ববাজারে দাম কমেছে
মুরগির খাদ্য তৈরির প্রধান দুই উপকরণ ভুট্টা ও সয়াবিনের উপজাত (মিল)। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, বিশ্ববাজারে এই উপকরণের দাম ব্যাপকভাবে কমেছে। ২০২২ সালে ভুট্টার গড় দাম ছিল টনপ্রতি ৩১৯ ডলার। কমতে কমতে তা গত মাসে ১৯৩ ডলারে নেমেছে। একইভাবে ৫৪৮ ডলারের সয়াবিন মিল গত মাসে বিক্রি হয়েছে ৪৮১ ডলারে। ফলে এখন আর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দেওয়া খাটে না। ওদিকে বাংলাদেশে পোলট্রি খাদ্যের দাম কমেনি। খাদ্য উৎপাদনকারীরা এখন সামনে আনছেন মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে।
দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান থেকে পোলট্রি খাদ্যের দাম সংগ্রহ করে দেখা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে যে দর ছিল, তার চেয়ে এখন ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির খাদ্যের দাম ৩৮ থেকে ৪১ শতাংশ বেশি।
আমাদের কোনো কর্মকর্তা সিন্ডিকেট বা কোনো ধরনের যোগসাজশের সঙ্গে জড়িত নন। আর আমদানির অনুমতি দিলে দেশে যে শিল্প গড়ে উঠেছে, তা ক্ষতির মুখে পড়বে।প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক
ক্ষুদ্র খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ভারতে যে ডিমের উৎপাদন খরচ প্রতিটি ৫ টাকার আশপাশে, বাংলাদেশে সেটা সাড়ে ১০ টাকা কেন হবে। ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ভারতে ৮২ টাকা, বাংলাদেশে তা কেন ১৭০ টাকা হবে। এর কারণ, পোলট্রি খাদ্যের দাম। তিনি বলেন, পোলট্রি খাদ্যশিল্পে ‘সিন্ডিকেট’ (অসাধু জোট) রয়েছে। সেই ‘সিন্ডিকেটের’ সঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে।
এ অভিযোগের বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, ‘আমাদের কোনো কর্মকর্তা সিন্ডিকেট বা কোনো ধরনের যোগসাজশের সঙ্গে জড়িত নন। আর আমদানির অনুমতি দিলে দেশে যে শিল্প গড়ে উঠেছে, তা ক্ষতির মুখে পড়বে।’
অবশ্য সুমন হাওলাদার বলছেন, সাদিক অ্যাগ্রোর সঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের যোগসাজশ ছাগল–কাণ্ডের পর বেরিয়ে এসেছে। তদন্ত করলে পোলট্রি খাদ্য উৎপাদনকারীদের সঙ্গে যোগসাজশও বের হবে।