তথ্য অধিকার
প্রকল্পের তথ্য দিতে বেশি গড়িমসি
প্রকল্প ও অর্থ বরাদ্দ–সংশ্লিষ্ট তথ্য দিতে গড়িমসি করার প্রবণতা ২০২২ সালের তুলনায় গত বছর আরও বেড়েছে।
দেশের তথ্য অধিকার আইনে নির্দিষ্ট কিছু তথ্য ছাড়া কারও আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সব তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু বিভিন্ন প্রকল্প ও অর্থ বরাদ্দ–সংশ্লিষ্ট তথ্য দিতে বেশি গড়িমসি করেন সরকারি কর্মকর্তারা। তথ্য কমিশনের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
প্রকল্প ও অর্থ বরাদ্দ–সংশ্লিষ্ট তথ্য দিতে গড়িমসি করার প্রবণতা ২০২২ সালের তুলনায় গত বছর আরও বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্পে নানা ধরনের দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগ আছে। তাই প্রকল্পের তথ্য দিতে কর্মকর্তারা গড়িমসি করেন।
২০২৩ সালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে তথ্য না পেয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা তথ্য কমিশনে মোট ৬৮৬টি অভিযোগ করেছিলেন। এর মধ্যে ৩২৪টি অভিযোগ আমলে নেয় তথ্য কমিশন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ৫২টি অভিযোগ প্রকল্পসংক্রান্ত তথ্য না পেয়ে। বরাদ্দসংক্রান্ত তথ্য চেয়ে না পেয়ে কমিশনে অভিযোগ আসে ২৯টি। এ ছাড়া দরপত্রসংক্রান্ত ১৭টি, নিয়োগসংক্রান্ত ১২টি তথ্য না পেয়ে অভিযোগ আসে। মোট ১০৬ ধরনের তথ্য না পেয়ে অভিযোগ এসেছে তথ্য কমিশনে।
৯ মে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে তথ্য কমিশনের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। ২০২২ সালে কমিশন ৩৬০টি অভিযোগ আমলে নিয়েছিল। এর মধ্যে সরকারি বরাদ্দ ও খাতওয়ারি ব্যয়সংক্রান্ত অভিযোগ ছিল ২৫টি, প্রকল্পসংক্রান্ত ছিল ২৩টি।
কোন কোন তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়, তা তথ্য অধিকার আইনে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। যেমন দেশের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হতে পারে এমন তথ্য। এর বাইরে অন্য যেকোনো তথ্যের জন্য আবেদন পাওয়ার ২০ কার্যদিবসের মধ্যে তথ্য দিতে হবে। আর কোনো তথ্যের সঙ্গে একাধিক কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা থাকলে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তা দিতে হবে।
এই তথ্য দেওয়ার জন্য সব প্রতিষ্ঠানে একজন কর্মকর্তা থাকেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নির্ধারিত সময়ে তথ্য না দিলে ওই প্রতিষ্ঠানের আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করা যায়। তারপরও তথ্য পাওয়া না গেলে বা কোনো প্রতিষ্ঠানে আপিল কর্তৃপক্ষ না থাকলে তথ্য কমিশনে অভিযোগ করা যায়।
তথ্য পেতে হয়রানি
কমিশনে অভিযোগকারীদের মধ্যে সাধারণ মানুষ বেশি, এই সংখ্যা ১৯৮। এরপর আছেন সাংবাদিক। ১২০টি অভিযোগ পড়েছে সাংবাদিকদের কাছ থেকে। প্রকল্পসংক্রান্ত তথ্য চেয়ে না পেয়ে গত বছর যাঁরা তথ্য কমিশনে অভিযোগ করেছিলেন, তাঁদের একজন খাগড়াছড়ির মো. শরিফুল ইসলাম ভুঁইয়া।
তথ্য কমিশনের ‘সিদ্ধান্তপত্র’ থেকে জানা যায়, খাগড়াছড়ির সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীন ৫টি অর্থবছরের উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়ে ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (আরটিআই) কাছে আবেদন করেন শরিফুল। নির্ধারিত সময়ে তথ্য না পেয়ে তিনি ২১ মে আপিল করেন। আপিল কর্তৃপক্ষ ৬ জুন নির্বাহী প্রকৌশলীকে তথ্য দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু শরিফুলকে তথ্য দেওয়া হয়নি। শুধু তা–ই নয়, তথ্য সরবরাহকারী কর্মকর্তা তথ্য না দিয়ে ৬৮ হাজার টাকা তথ্য-মূল্য চেয়ে আবেদনকারীকে চিঠি দেন। কিন্তু কোন কোডে টাকা জমা দেবেন, তা জানাননি। পরে শরিফুল তথ্য কমিশনে অভিযোগ করেন।
শরিফুলের অভিযোগ আমলে নিয়ে গত বছরের ১৫ নভেম্বর উভয় পক্ষকে নিয়ে ভার্চ্যুয়াল শুনানি করে তথ্য কমিশন। কমিশন সিদ্ধান্ত দেয়, তথ্য সরবরাহ না করে তথ্যের অবাধ প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। কমিশন তথ্য সরবরাহকারী কর্মকর্তাকে তথ্য দিতে এবং নির্বাহী প্রকৌশলীকে ভবিষ্যতে সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দেন।
প্রকল্পের তথ্য দিতে শুধু গড়িমসি নয়, অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হয়রানিও করেন সরকারি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ। যেমন গত মার্চে শেরপুরের নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে তথ্য চাইতে যাওয়া সাংবাদিক শফিউজ্জামানকে কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
দৈনিক দেশ রূপান্তর–এর উপজেলা সংবাদদাতা শফিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একটি প্রকল্পের আওতায় কম্পিউটার, ল্যাপটপ ক্রয়সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন জমা দিতে গত ৫ মার্চ ইউএনওর কার্যালয়ে যান। আবেদন জমা দিয়ে তিনি ওই কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর কাছে রিসিভড কপি (প্রাপ্তিস্বীকার) চাইলে তাঁকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। একপর্যায়ে ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিন বাইরে এসে তাঁকে গালিগালাজ করেন। তিনি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) ডাকেন।
শফিউজ্জমান বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে দণ্ডবিধির ১৮৮ ধারা (সরকারি কাজে বাধা) ও ৫০৯ ধারায় (নারীর শ্লীলতাহানি) এক মাস ও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। এক সপ্তাহ পর তিনি জামিন পান।
তথ্য কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে ঘটনাটি তদন্ত করে। তথ্য সরবরাহে সহযোগিতা না করে তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগকে বাধাগ্রস্ত করায় ২ এপ্রিল নকলার ওই ইউএনওর বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে তথ্য কমিশন।
তথ্য কমিশনার শহীদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের নীতি হচ্ছে গোপনীয় নয় এমন সব তথ্য প্রকাশ করতে হবে। তথ্য কমিশন যেসব অভিযোগ পায়, সেগুলো নিষ্পত্তি করে। যাঁরা অবাধ তথ্যপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
২০২৩ সালে তথ্য কমিশনে জমা হওয়া অভিযোগ ছিল ১১৪ ধরনের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়–সংশ্লিষ্ট অভিযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি, ২০টি; যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে দুর্নীতির যে ক্ষেত্রগুলো আছে, তার অন্যতম উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ঘিরে। যদিও জনস্বার্থে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে নানাভাবে দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগ আছে। আর প্রকল্পসংক্রান্ত তথ্য দিতে কর্মকর্তাদের গড়িমসি সেটারই প্রতিফলন বলে মনে করা যেতে পারে।