ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যের সঙ্গে কী হয়েছিল সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের

পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্যে সড়কে আগুন জ্বালিয়েছে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা, ২৬ জানুয়ারিছবি: প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) মামুন আহমেদের সঙ্গে বাহাসের পর গতকাল রোববার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অধিভুক্ত রাজধানীর সাত সরকারি কলেজের একদল শিক্ষার্থী। পরে রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত রাজধানীর নীলক্ষেত-নিউ মার্কেট এলাকায় সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে দুই পক্ষের অনেকে আহত হন। কিন্তু কেন এই সংঘর্ষ?

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) মামুন আহমেদকে একটি স্মারকলিপি দিয়েছিলেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। সেখানে সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ‘অযৌক্তিক’ কোটাপদ্ধতি বাতিলসহ পাঁচ দফা দাবি ছিল। সেই স্মারকলিপির বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হলো, তা জানতে শিক্ষার্থীরা গতকাল বিকেলে মামুন আহমেদের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

নিজের কার্যালয়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য মামুন আহমেদ ‘দুর্ব্যবহার’ করেন—এমন অভিযোগে শিক্ষার্থীরা গতকাল সন্ধ্যায় সায়েন্স ল্যাব অবরোধ করেন। কার্যালয়ে কী ঘটেছিল, সেই ঘটনার পৌনে তিন মিনিটের একটি ভিডিও চিত্র গতকাল রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভিডিওটি সেই ঘটনারই।

ভিডিওতে সহ-উপাচার্য মামুন আহমেদকে বলতে শোনা যায়, ‘প্লিজ কিপ দিস ইন মাইন্ড, ইউ কান্ট ডু মবিং। আমি তোমাদের বলেছি দুজন আসতে। কেন বলেছি দুজন আসতে? কারণ, আমি তোমাদের কথাটা শুনতে চাই, হোয়াট ইজ ইয়োর প্রবলেম। বাট তুমি দলবল নিয়ে আমার রুমে ঢুকেছ এবং তুমি আমাকে বলেছ, আপনি অস্বীকার করছেন। প্লিজ।’

তখন সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের একজন বলেন, ‘সাত কলেজের কথা তো আমরা দুজন বলতে পারি না।’ উত্তরে মামুন আহমেদ বলেন, ‘কেন বলতে পারো না? তোমার যা বক্তব্য, রিপ্রেজেনটেটিভ (প্রতিনিধি) হিসেবে বলবা। ওকে?’ এর জবাবে সাত কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘অন্য কলেজ তো মানবে না, স্যার।’ মামুন আহমেদ তখন বলেন, ‘কোনো কলেজ যদি না মানে, দ্যাট’স নট মাই বিজনেস। ওকে?’

এই পর্যায়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা মামুন আহমেদকে বলেন, ‘...আপনিও কিন্তু স্যার অ্যাগ্রেসিভ (উত্তেজিত) হয়ে গেছেন।’ জবাবে মামুন আহমেদ বলেন, ‘অ্যাগ্রেসিভ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কেন বলছ যে আমি অস্বীকার করছি। অস্বীকার করার মানেটা কী, বলো।’ এ সময় সাত কলেজের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘আপনাকে যখন আমরা বলেছিলাম যে “স্যার, আমাদের জন্য বিশেষজ্ঞ টিমটা তো আছেই; আপনি হয়তো বুঝতে পারেননি বা যেকোনো কারণেই হোক আপনি বলেছেন কিসের কমিটি, আমি জানি না।’ এ কথাটাই উনি (আরেক শিক্ষার্থী) বলতে চেয়েছেন।...কিন্তু স্যার, আপনি যেভাবে অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেলেন, এই আচরণটা কিন্তু খুব গ্রহণযোগ্য আচরণ না।’

সাত কলেজের এক ছাত্রীর এই কথার পর মামুন আহমেদ বলেন, ‘অবশ্যই গ্রহণযোগ্য আচরণ।’ শিক্ষার্থীদের দিক থেকে এ সময় আরও কয়েক লাইন বলার পর মামুন আহমেদ তাঁর চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে দুই হাত তুলে বলেন, ‘সরি, আই এম নট গোয়িং টু টেল ইউ এনিথিং, আই এম স্যরি।’ ওই ছাত্রী তখন বলেন, ‘আপনার দায়িত্ব এটা, স্যার।’ জবাবে মামুন আহমেদ বলেন, ‘আমার দায়িত্ব তোমাদের কথা এভাবে শোনা না।’

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাহাসের একপর্যায়ে মামুন আহমেদ বলেন, ‘তোমাদের কথা বারবার শোনার জন্য আমি এখানে বসিনি।’ সাত কলেজের এক ছাত্র বলেন, ‘উই আর ইয়োর স্টুডেন্টস, স্যার।’ এ সময় ওই ছাত্রী বলেন, ‘আমরা লিখিতভাবে দিয়েছি, লিখিত বিষয়টার কোনো ফলাফল পাইনি বলে আমরা আবার এসেছি। আমি এবং আরেকজন ছাড়া আমরা কেউ এখানে কথা বলিনি। আপনি বলছেন, আমরা এখানে মবিং করছি। এটা কোনো কালচার হলো, স্যার? আপনি এ রকম অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেছেন, এই আচরণ দেখে আমাদের কষ্ট হয়।’

আরও পড়ুন

এরপর ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আবদুর রহমান কথা বলেন। তিনি মামুন আহমেদকে বলেন, ‘স্যার, আমরা বলেছি, আমরা ৫ (জানুয়ারি) তারিখে যে স্মারকলিপিটি দিয়েছি, সেটা আপনি পড়েছিলেন কি না৷ আপনি বললেন, কোনটা দিয়েছি সেটা উল্লেখ করতে। সেটা আমরা উল্লেখ করলাম যে সিট কমানোরটা। আপনি জানেন, আমরা আর পারছি না। আমাদের এখানে মিলছে না দেখে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় বা যেকোনো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে...।’ এখানেই ভিডিওটি শেষ হয়ে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যের কার্যালয়ে ওই ঘটনার পর নিজেদের পাঁচ দফা ও সহ-উপাচার্য মামুন আহমেদকে তাঁর আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করার দাবিতে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করেন সাত কলেজের একদল শিক্ষার্থী। একপর্যায়ে সড়ক ছেড়ে দিয়ে তাঁরা ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। এরপর রাত ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সহ-উপাচার্য মামুন আহমেদের বাসভবন ঘেরাও করতে মিছিল নিয়ে রওনা দেন তাঁরা।

মিছিলটি ক্যাম্পাসের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণে পৌঁছানোর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। এই সংঘর্ষ গড়ায় নীলক্ষেত-নিউ মার্কেট এলাকা পর্যন্ত। পুলিশ ও বিজিবি সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে মাঠে ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহও ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন।

এদিকে গতকাল দিবাগত রাত একটার দিকে এক ভিডিও বার্তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ বলেন, ‘গতকাল (রোববার) সন্ধ্যায় সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার অফিসে আলোচনাকে কেন্দ্র করে রাতে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে, তা দুঃখজনক। এতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত।’

আরও পড়ুন

মামুন আহমেদ বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, সুষ্ঠু পরিবেশে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে এই ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তা প্রশমিত করার জন্য সব পক্ষকে ধৈর্য ধারণ করার জন্য আমি আহ্বান করছি।’

অবশ্য গতকাল দিবাগত রাত তিনটা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সড়কে ছিলেন। তাঁরা আজ সোমবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা কলেজের শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন ছয় দফা দাবি মানতে চার ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন। এক নম্বর দাবি হলো, ঢাকা কলেজসহ সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংঘাতের দায় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদকে পদত্যাগ করতে হবে।

এদিকে আজ সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকছে না। ওই বৈঠক শেষে লিখিত বক্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ এ কথা জানিয়েছেন।