বইমেলায় বই নিষিদ্ধ হয় যেভাবে, প্রভাব কতটা
গত বছরের অমর একুশে বইমেলা ব্যতিক্রমী ছিল একটি বিশেষ কারণে। গত মেলায় তিনটি বই বিক্রি ও প্রদর্শনী বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল মেলা কর্তৃপক্ষ। এক মেলায় সবচেয়ে বেশি বইয়ের বিক্রি বন্ধের ঘটনা ছিল এটি। এ নিয়ে গত আট বইমেলায় পাঁচটি বই বিক্রি–প্রদর্শনী বন্ধের নির্দেশ এসেছে।
বইমেলায় কোনো বই নিষিদ্ধ হওয়া মানে বইটি শুধু মেলায় বিক্রি ও প্রদর্শন করা যাবে না। দেশে কোনো বই নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা বইমেলা কর্তৃপক্ষের নেই। তারা শুধু মেলায় বিক্রি ও প্রদর্শন বন্ধ করে দিতে পারে। তবে বই দেশে নিষিদ্ধের ঘটনাও আছে। এ ক্ষমতা রয়েছে শুধু আদালতের।
বইমেলায় কোনো বই বিক্রি ও প্রদর্শন বন্ধের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে প্রকাশক ও মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, বইমেলায় কোনো বই নিষিদ্ধ হওয়া মানে ওই বই মেলা ছাড়া অন্য যেকোনো মাধ্যমে প্রকাশক বিক্রি করতে পারেন। তবে আদালত যদি কোনো বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন, তাহলে বইটি সারা দেশেই বিক্রি ও প্রদর্শন করা বন্ধ হয়ে যায়।
আট মেলায় নিষিদ্ধ যেসব বই
গত বছর বইমেলায় নিষিদ্ধ বই তিনটি হলো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আদর্শ থেকে প্রকাশিত ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’, নালন্দা থেকে প্রকাশিত ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ এবং গতিধারা থেকে প্রকাশিত ‘প্রেসিডেন্টের লুঙ্গি নাই’। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মেলা থেকে বই তিনটি তুলে নেওয়া হয়।
এর আগে সর্বশেষ ২০১৭ সালে বইমেলায় বই নিষিদ্ধ হয়। বইটি ছিল রোদেলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত অনূদিত বই ‘নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর’। এর এক বছর আগে ২০১৬ সালের মেলায় বদ্বীপ প্রকাশনীর ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে একটি বই বিক্রি ও প্রদর্শনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
অমর একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বইমেলায় আদর্শকে স্টল বরাদ্দ দিতে না চাওয়ার কারণ ছিল ফাহাম আব্দুস সালামের “বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে” বইটি নিয়ে। এ সিদ্ধান্ত নেয় মেলা পরিচালনা কমিটি।’
আদর্শ থেকে প্রকাশিত ‘উন্নয়ন বিভ্রম’ এবং ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা’ নিয়েও গত বইমেলায় আলোচনা ছিল।এ বইগুলো নিয়ে মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি শেষ পর্যন্ত। আদর্শকে মেলায় স্টল বরাদ্দ না দেওয়া এবং এ নিয়ে আদালত পর্যন্ত গড়ায় বিষয়টি। পরে উল্লিখিত বইগুলো বিক্রি ও প্রদর্শন না করার শর্তে স্টল বরাদ্দ পায় আদর্শ।
গত বছর বইমেলায় নিষিদ্ধ বই তিনটি হলো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আদর্শ থেকে প্রকাশিত ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’, নালন্দা থেকে প্রকাশিত ‘জন্ম ও যোনির ইতিহাস’ এবং গতিধারা থেকে প্রকাশিত ‘প্রেসিডেন্টের লুঙ্গি নাই’। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মেলা থেকে বই তিনটি তুলে নেওয়া হয়।
যে প্রক্রিয়ায় মেলায় নিষিদ্ধ হয় বই
বইমেলার জন্য একটি টাস্কফোর্স কমিটি আছে। কোনো বই নিয়ে মেলায় বিতর্ক তৈরি হলে বইটি মেলায় বিক্রি ও প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে এই কমিটি। কমিটি এ রকম নির্দেশ দিলে বইটি যে প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে, তারা মেলায় বইটি প্রদর্শন বা বিক্রি করতে পারে না।
কয়েক বছর ধরে বইমেলার টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন অসীম কুমার দে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বইমেলা চলাকালে যেসব বইকে মেলার নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করা হয়, সেসব বই বিক্রি ও প্রদর্শন বন্ধের ওপর নির্দেশনা আসে। তবে প্রকাশক মেলা ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে অবশ্য সেই বই বিক্রি বা প্রদর্শন করতে পারেন।’
গত বইমেলায় নিষিদ্ধ তিনটি বইয়ের মধ্যে দুটির প্রকাশক ছিল নালন্দা ও আদর্শ প্রকাশনী। দুই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, মেলায় নিষিদ্ধ হওয়া বই মেলা বাদে অন্য মাধ্যমে প্রদর্শন ও বিক্রি করতে পারছেন তারা। কোনো সমস্যা হয়নি।
২০১৬ ও ২০১৭ সালের বইমেলায় দুটি বই বিক্রি ও প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বাংলা একাডেমি বইমেলা কমিটির তৎকালীন সচিব জালাল আহমেদের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলা একাডেমি বইমেলার বই ছাড়া অন্য বই নিয়ে কথা বলে না। শুধু নতুন বইয়ের ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত হবে এমন নয়, সংরক্ষণ নীতি অনুসারে অন্য দেশের লেখকের বই, কপিরাইট (গ্রন্থস্বত্ব) ছাড়া বই বা অন্য দেশে প্রকাশিত বইয়ের ক্ষেত্রেও এই বিধিনিষেধ দেওয়া হতে পারে।’
বইমেলা চলাকালে যেসব বইকে মেলার নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করা হয়, সেসব বই বিক্রি ও প্রদর্শন বন্ধের ওপর নির্দেশনা আসে। তবে প্রকাশক মেলা ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে অবশ্য সেই বই বিক্রি বা প্রদর্শন করতে পারেন।বইমেলার টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি অসীম কুমার দে
বাংলাদেশে নিষিদ্ধ দেশি-বিদেশি বই
বাংলাদেশে এর আগে একাধিক বই নিষিদ্ধ করার ঘটনা ঘটেছে। তসলিমা নাসরীনের লেখা ‘লজ্জা’ ও ‘ক’ নামে দুটি বই দেশে নিষিদ্ধ করা হয়। সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো প্রত্যাহার হয়নি।
কোনো বই নিষিদ্ধ করার পর আবার সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘটনাও আছে। যেমন হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ বইটি ১৯৯৫ সালে নিষিদ্ধ করা হয়। এর প্রায় সাড়ে চার বছর পর ২০০০ সালে বইটির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়।
এ ছাড়া বাংলাদেশে নিষিদ্ধ বিদেশি বইয়ের তালিকায় আছে গত শতকের বিশের দশকে ভারতের পাঞ্জাব থেকে প্রকাশিত ‘রঙ্গিলা রসুল’ নামের বইটি। পণ্ডিত এম এ চমুপতির লেখা বইটি ১৯৩০ সালের আগে নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার। ‘হেট স্পিচ’ অর্থাৎ বা বিদ্বেষমূলক অভিযোগ তুলে বইটি তখন থেকে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। এ ছাড়া সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ বিদেশি বইয়ের তালিকায় আছে।
বাংলাদেশে এর আগে একাধিক বই নিষিদ্ধ করার ঘটনা ঘটেছে। তসলিমা নাসরীনের লেখা ‘লজ্জা’ ও ‘ক’ নামে দুটি বই দেশে নিষিদ্ধ করা হয়। সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো প্রত্যাহার হয়নি।