সস্তা আমিষও এখন নাগালের ‘বাইরে’
বাজারে যে মাছগুলোর বছরের পর বছর ‘সস্তা’ বলে পরিচিতি ছিল, তা এখন দামি হয়ে উঠেছে। যেমন পাঙাশ। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের (ডিএএম) হিসাবে, ২০১৩ সালে সারা দেশ মিলিয়ে ছোট পাঙাশের প্রতি কেজির গড় দাম ছিল ১১৪ টাকা। ২০২১ সালে এই দর ছিল ১১১ টাকা। এখন ঢাকার বাজারে ছোট পাঙাশ বিক্রি হয় প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকা দরে। একটু বড় হলে দাম ২৫০ টাকার আশপাশে ওঠে।
পাঙাশের মতো তেলাপিয়া, চাষের কই, রুই, কাতলা ইত্যাদি চাষের মাছের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে। এসব মাছ স্বল্প আয়ের মানুষের প্রাণিজ আমিষের বড় উৎস।
মাছের বিকল্প হিসেবে নিম্ন আয়ের মানুষ ডিম বা ব্রয়লার মুরগি থেকে পুষ্টি নেবে, সে উপায়ও নেই বললেই চলে। কারণ, মাছের মতোই বেড়েছে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম। আর গরু ও খাসির মাংসের দাম তো বছর বছর বাড়ছে। বেড়েছে দুধের দামও।
বাড়িতে ফোন করলে এখন আর জানতে চাই না কী রান্না হয়েছে। কারণ, বেশির ভাগ দিনই তাঁদের নিরামিষ খেতে হয়।
চাল, ডাল, তেল, চিনি ও আটার দাম অনেক দিন ধরেই চড়া। নতুন করে আলোচনায় পেঁয়াজ। গত শনিবার ভারত রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
ঢাকার মালিবাগ বাজারে গিয়ে গতকাল বুধবার দেখা গেল, টালি খাতা বিক্রেতা ফারুক আহমেদ কাঁচাবাজার করতে এসেছেন। থামিয়ে বাজার ও সংসার ব্যয়ের পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যয়ের চাপ সামলাতে না পেরে ছয় মাস আগে স্ত্রী ও চার সন্তানকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। নিজে মেসে থাকেন। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে ফোন করলে এখন আর জানতে চাই না কী রান্না হয়েছে। কারণ, বেশির ভাগ দিনই তাঁদের নিরামিষ খেতে হয়।’
ঢাকার মালিবাগ, মগবাজার, সেগুনবাগিচা ও মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের বাজার ঘুরে গতকাল দেখা যায়, এখন মাঝারি রুই মাছ কিনতে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা দিতে হচ্ছে।
মাছের দাম: তখন, এখন
মাছের দাম যে বহু বছর স্থিতিশীল ছিল, তার কারণ উৎপাদনে সাফল্য। ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে মিঠাপানির মাছের উৎপাদন ছিল প্রায় ২৭ লাখ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ লাখ টনে। চাষের মাছের মধ্যে রুই, কাতলা, তেলাপিয়া ও পাঙাশই বেশি উৎপাদিত হয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার–২০২২’ প্রতিবেদন বলছে, মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর চারটি মাছের দামের হিসাব রাখে। পাঙাশ, মাঝারি রুই, কাতলা ও ইলিশ। দেখা যায়, ২০২১ সাল পর্যন্ত রুই–কাতলার দামও মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। যেমন মাঝারি রুইয়ের গড় দাম ২০১৩ সালে ছিল প্রতি কেজি ৩১২ টাকা। ২০২১ সালে তা ৩০৪ টাকায় বিক্রি হয়।
ঢাকার মালিবাগ, মগবাজার, সেগুনবাগিচা ও মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের বাজার ঘুরে গতকাল দেখা যায়, এখন মাঝারি রুই মাছ কিনতে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা দিতে হচ্ছে। মগবাজারের মাছ বিক্রেতা মাইনউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দাম তো অনেক দিন ধরেই বাড়তি। সব জিনিসের দামই বেড়েছে। সেই সঙ্গে মাছেরও।
তেলাপিয়া ও চাষের কইয়ের দামের হিসাব কৃষি বিপণন অধিদপ্তর রাখে না। তবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২১ সালেও আকারভেদে প্রতি কেজি তেলাপিয়া ১৪০ থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে পাওয়া যেত, যা এখন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। মাঝারি চাষের কইয়ের দামও সাধারণত প্রতি কেজি ১৬০ থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে থাকত। এখন তা ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা।
মাছের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে মূলত ২০২২ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর। একদিকে মাছের খাবারের উপকরণ আমদানির ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে দেশে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। কারণ, সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাহবুবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে অন্যান্য আমিষের দাম যেহেতু বেশি, সেটার প্রভাব মাছের দামের ওপর পড়েছে। খাবারের দামও বাড়তি। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাজার তদারকির সঙ্গে যুক্ত সরকারের কোনো সংস্থা যদি মাছের দাম নিয়ে কাজ করতে চায়, আমরা তাদের সহযোগিতা করব।’ তিনি বলেন, ‘বাজারে মাছের দাম কত হবে, সেটা চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে ঠিক হয়। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। আমাদের কাজ খামারিদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলো দেখভাল করা। উৎপাদন ঠিক রাখা। উৎপাদন সঠিক পথে আছে।’
উৎপাদন খরচ আসলে কতটা বেড়েছে, দেশের বাজারে দাম কতটা বৃদ্ধি যৌক্তিক, কমাতে কী করতে হবে, সে বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে কোনো বিশ্লেষণ নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তেল, চিনি, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্যের বাজার তদারক করে। তবে মাছের বাজারে কারও তদারকি নেই।
বাংলাদেশ ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও মেগা ফিডের পরিচালক মো. আহসানুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশে এ বছর মাছের খাদ্যের দাম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। যদিও কাঁচামালের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ।
মাছের খাদ্যের মূল উপকরণের দুটি ভুট্টা ও সয়ামিল। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, গত অক্টোবর–ডিসেম্বর সময়ে বিশ্ববাজারে ভুট্টার টনপ্রতি দাম ছিল ৩২২ মার্কিন ডলার, যা গত জুলাইয়ে নেমেছে ২৪২ ডলারে। গত জানুয়ারি–মার্চ সময়ে যে সয়ামিল প্রায় ৬০০ ডলার ছিল, তা নেমেছে ৫১৭ ডলারে। একই সময়ে অবশ্য ডলারের দাম বেড়েছে।
মাছের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে মূলত ২০২২ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর। একদিকে মাছের খাবারের উপকরণ আমদানির ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে দেশে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। কারণ, সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে।
মাংস, ডিম ও দুধ
প্রাণিজ আমিষের দুটি সস্তা উৎস ফার্মের মুরগির ডিম ও ব্রয়লার মুরগি। মাছের মতো এই দুটি পণ্যের দামও দীর্ঘদিন স্থিতিশীল ছিল। এক বছর ধরে দাম ব্যাপক চড়া। যেমন যে ডিমের দাম ডজনপ্রতি ১০০ টাকার আশপাশে থাকত, তা এখন ১৫০ টাকার আশপাশে।
বছর বছর গরুর মাংসের গড় দাম বেড়েছে। এখন গরুর মাংসের কেজি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, যা একজন নতুন পোশাকশ্রমিকের তিন দিনের মজুরির সমান। মধ্যম আয়ের মানুষের জন্যও দামটি অনেক বেশি।
ঢাকার মিরপুরের ৬ নম্বর সেকশনের বাজারে কেনাকাটা করতে যাওয়া স্থানীয় বাসিন্দা শারমিন সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, মধ্যবিত্তের জন্য বাজার করাটা এখন কঠিন।
শারমিনের সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছেলে ওয়াদি খান। মায়ের সঙ্গে যোগ করে তিনি বললেন, ‘কোরবানি ছাড়া তো গরু মাংসই কেনা হয়নি অনেক দিন।’
বাজারে অন্যান্য আমিষের দাম যেহেতু বেশি, সেটার প্রভাব মাছের দামের ওপর পড়েছে। খাবারের দামও বাড়তি। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাজার তদারকির সঙ্গে যুক্ত সরকারের কোনো সংস্থা যদি মাছের দাম নিয়ে কাজ করতে চায়, আমরা তাদের সহযোগিতা করব
প্রাণিজ আমিষ কতটা জরুরি
নির্দিষ্ট পরিমাণ মাছ-মাংস খেলে ঢাকায় একটি পরিবারের খাবার খরচ কত হয়, তা গত বছর অক্টোবরে জানিয়েছিল বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তাদের হিসাব, খরচটি ২২ হাজার ৪২১ টাকা। বিগত পৌনে চার বছরে এই ব্যয় ২৭ থেকে ৩৮ শতাংশ বেড়েছে।
২০২২ সালের অক্টোবরে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক জরিপভিত্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে খাবার কিনতে হিমশিম অবস্থা ৬৮ শতাংশ মানুষের। মাছ, মাংস, সামুদ্রিক খাদ্যসহ পুষ্টিকর উপাদানসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারছে মাত্র ১৭ শতাংশ পরিবার। বাকিরা পারছে না।
বছর বছর গরুর মাংসের গড় দাম বেড়েছে। এখন গরুর মাংসের কেজি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা, যা একজন নতুন পোশাকশ্রমিকের তিন দিনের মজুরির সমান। মধ্যম আয়ের মানুষের জন্যও দামটি অনেক বেশি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাধারণভাবে শিশু, গর্ভবতী মা ও অপুষ্টিতে ভোগা নারীদের এ ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। এই খাবারগুলো তাঁদের নিয়মিতভাবে না পাওয়া আশঙ্কাজনক।
বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ শামছুন্নাহার নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই পরিস্থিতিতে শিশু ও গর্ভবতী নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। প্রাণিজ আমিষ না পেলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধা পায়। গর্ভবতী নারী পুষ্টি না পেলে সন্তান জন্মদান ও পরবর্তী সময়ে নানা সমস্যার মুখে পড়েন।