‘আরও কত কিছু দিতে পারতাম আমরা, রাষ্ট্র বুঝল না’
মুজিবুল হক স্থির থাকতে পারেন না। প্রবীণ নিবাসের বিশাল চৌহদ্দিও তাঁর কাছে ছোট মনে হয়। গতকাল সোমবার ঈদের বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রবীণ নিবাসে প্রবেশ করার সময় বাইরে দেখা গেল, মুজিবুল হক লাঠি হাতে রাস্তার অন্য পাশ থেকে টুকটুক করে আসছেন। চোখে চোখ পড়তেই কাঁচুমাচু করছিলেন, যেন ধরা পড়া গেছেন। ৭৮ বছর বয়সী মানুষটি বলেন, ‘বেশিক্ষণ আগে যাই নাই।’ এখানে কত দিন ধরে আছেন জানতে চাইলে বলেন, ৩২ বছর আগে এসেছেন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাস কি ৩২ বছর আগে ছিল জিজ্ঞাসা করলে মুজিবুল হক বেশ বিরক্তই হলেন। বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের (বাইগাম) প্রবীণ নিবাসের সদস্যরা সাধারণত একা একা সীমানার বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে যান না। মুজিবুল হক ব্যতিক্রম। কর্তৃপক্ষ জানান, একসময় কলেজের শিক্ষকতা করে অবসরে যাওয়া এই নিবাসী এখানকার প্রথম দিকের একজন সদস্য। দীর্ঘদিন ধরে একই জায়গায় থাকতে থাকতে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গেও খুব ভাব হয়েছে। তিনি মানুষের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করেন আর খেতে খুব ভালোবাসেন। সারা দিন দোকান থেকে এটা-সেটা কিনে খেতেই থাকেন। তাই তাকে মাঝেমধ্যেই প্রবীণ নিবাসের বাইরের পথে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়।
এবারের কোরবানির ঈদে প্রবীণ নিবাসে ছিলেন ২৯ জন নিবাসী। এখন এখানকার মোট বাসিন্দা ৩০ জন। তাঁদের একজন আপাতত ছেলের বাড়িতে গেছেন। ফিরে আসবেন আবার। ঈদের দিন বিকেলে এখানকার নিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কেউ ইচ্ছা করে পরিবারের কাছে যাননি, কারও কারও যাওয়ার সুযোগ নেই; আর অল্প কয়েকজন আছেন, যাদের পরিবারই নেই। যেমন ৪০৭ নম্বর কক্ষের ৭০ বছরের নাদিরা বেগম। তাঁর স্বামী বেঁচে নেই, নিজের সন্তানও নেই। আছে ভাইয়ের পরিবার। ওই কক্ষে দুবার উঁকি দিয়ে দেখা গেল গোলাপি রঙের সালোয়ার–কামিজ পরে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছেন। এমন বিশেষ দিনে তাঁর সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসেনি।
বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের (বাইগাম) উপপরিচালক ( প্রশাসন) মো. মোহসীন কবির প্রথম আলোকে বললেন ‘রোজার ঈদের সময় ৩৬ জন নিবাসী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে দুজন মারা গেছেন; আর চারজন পরিবারের কাছে ফিরে গেছেন। এখন আছেন ৩০ জন। তাঁদের মধ্যে চার–পাঁচজন আছেন, যাঁদের না আছে ফেরার জায়গা, না আছে অভিযোগ করার স্বাধীনতা। এ ছাড়া বাকিরা মোটামুটি সচ্ছল। নিজের ইচ্ছায় থাকা নিবাসীও আছেন।’
যেমন ৬৫ বছর বয়সী সীমা জামান। হাসিখুশি এই নিবাসী জানান, রাজধানীর ইব্রাহিমপুরে নিজের বাড়ি ছিল। তাঁর স্বামী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি প্রয়াত হওয়ার পর নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। তাঁর দুই মেয়ে। দুজনই ভালো আছেন নিজেদের সংসারে। কথা প্রসঙ্গে শখ করে হাতের একটি ব্যাগ দেখিয়ে বললেন, এটি তাঁর ছোট মেয়ের সেলাই করে দেওয়া। ঈদের দিনেও তাহলে এখানে কেন আছেন জানতে চাইলে বলেন, তিনি রাতে বড় মেয়ের বাসায় যাবেন। মেয়ের যৌথ পরিবার। দুটি দিন থেকে আবার ফিরবেন। তা ছাড়া এখানে দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে এই নিবাসের অন্যরাও এখন তাঁর পরিবারের অংশ।
পারিবারিক সম্পর্ক যে তৈরি হয়েছে তা বোঝা গেল পাশের কক্ষের নিবাসী রাশিদা জামানের ‘মেয়ে’ সম্বোধনে। ৮৮ বছরের রাশিদা জামান সীমা জামানকে মেয়ে বলেন। চশমা না পেলেই ডাকেন তাঁকে। তবে রাশিদা জামান সাধারণত কথা বলতে চান না কারও সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান, ভাষাবিদ ও কবি প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের স্ত্রী রাশিদা জামান নিজের পরিচয়েই পরিচিত। তিনি ছিলেন রাজধানীর ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রথম দিকের শিক্ষিকা। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন কার্যক্রম শুরু করলে সেখানে তিনি শিক্ষাবিষয়ক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন।
৮৮ বছরের রাশিদা জামান দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জীবন নিয়ে এখনো গুরুত্বের সঙ্গে ভাবেন ও মতামত দেন। তাঁর দুই ছেলেমেয়েই প্রতিষ্ঠিত। রাশিদা জামান এই ছোট্ট ঘর লাগোয়া বারান্দাতেও একটা তুলসীগাছ লাগিয়েছেন। প্রথম আলোকে বলেন ‘আমি মনে করি, কোনো মানুষের মধ্যে ভাবনা থাকলেই সে সমাজকে কিছু না কিছু দিতে পারে। নিজের সময়টাকে কাজে লাগানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রবীণ নিবাসে অনেকেই আছেন, যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন সমাজে।’ তিনি বলেন ‘রিডার ডাইজেস্টে পড়েছি, জাপানের প্রবীণদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে তাঁদের বিভিন্ন কাজে নানাভাবে সম্পৃক্ত করা হয়। এই প্রবীণ নিবাস কেন তৈরি হয়েছিল? এখানে দেশের প্রবীণদের বিষয়ে গবেষণা হওয়ার কথা ছিল। অথচ এটা হয়ে গেল শুধু বৃদ্ধদের থাকার জায়গা। আরও কত কিছু দিতে পারতাম আমরা, রাষ্ট্র বুঝল না।’
রাশিদা জামান আরও বলেন, এই নিবাসে নিজের ইচ্ছায় এসে থাকছেন বলে গত এক যুগে তিনি এখানে বসে পাঁচটি বই লেখার কাজ শেষ করতে পেরেছেন। তিনি নিজের মতো থাকতে পছন্দ করেন। ঈদের দিন তাঁর পরিবারের সদস্যরা এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে গেছেন।
এমন একাকিত্ব পছন্দ করেন এই নিবাসের সবচেয়ে নবীন সদস্য মো. নূরুল ইসলাম। ৭২ বছর বয়সী এই নিবাসী এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসেছেন এখানে। তবে তাঁর থাকার জায়গাটি এখানকার হাসপাতাল ভবনে। সাবেক ব্যাংকার নূরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যুক্তরাজ্য থেকে ফোন এল তাঁর বড় বোন আয়েশা রহমানের। ঈদের দিন ভাইয়ের খবর নিতে ফোন করেছেন তিনি। গণমাধ্যমের কথা শুনে আগ্রহী হয়ে নিজে থেকেই কথা বলতে চাইলেন। আয়েশা রহমান বলেন ‘আমি ৫৭ বছর ধরে যুক্তরাজ্যে আছি। এখনো আমাদের ভাইবোনের সমান উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা কাজ করে সবার জন্য। বৃদ্ধাশ্রমের সবাই যে পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়ে সেখানে যান, এটা ঠিক নয়। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় একা থাকতেও যান। এই সত্যটা আপনারা কখনো লেখেন না কেন?’
জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ অনুযায়ী ৬০ বছর বা এর বেশি বয়সী ব্যক্তিরা প্রবীণ। তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে মেডিসিনবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ কে এম আবদুল ওয়াহেদ রাজধানীর ধানমন্ডিতে তাঁর বাসভবনে ১৯৬০ সালে বাইগাম গড়ে তোলেন। বর্তমানে আগারগাঁওয়ে প্রবীণ ভবনে ৫০ শয্যার প্রবীণ হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট অব জেরিয়েট্রিক মেডিসিন (আইজিএম) এবং পাশে একটি ভবনে ৫০ শয্যার প্রবীণ নিবাস রয়েছে। নিবাসে বাসিন্দা আছেন এখন ৩০ জন। ২০০০ সালে চালু হওয়া নিবাসটি ভর্তুকি দিয়ে চালাতে হচ্ছে।
বর্তমানে এখানকার নিবাসীর মধ্যে কতজন নিজের ইচ্ছায় আছেন আর কতজন পরিবারের কাছে বোঝা হওয়া থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, জানতে চাওয়া হয় কর্তৃপক্ষের কাছে। বাইগামের উপপরিচালক ( প্রশাসন) মো. মোহসীন কবির প্রথম আলোকে বলেন, অর্ধেক নিবাসীই নিজেদের ইচ্ছায় আছেন। তবে এখানে একটি সংকট আছে। অনেকেরই সামাজিক অবস্থান এমন যে পরিবারের ভেতরের ব্যাপারটি তাঁরা প্রকাশ্যে আনতে স্বস্তিবোধ করেন না। গণমাধ্যমে তাঁদের সব কথা এলে পরিবারের পক্ষ থেকে কথা শোনানো হয়। অনেকেই নিজে কষ্ট পান তবুও সন্তানকে মানুষের কাছে ছোট করতে চান না বলে আড়াল করেন কথা।