দিনাজপুর শহরের অদূরে অবস্থিত প্রায় ৬০০ বছরের পুরোনো চেহেলগাজী মাজার ও তৎসংলগ্ন মসজিদ। স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি চেহেলগাজী পীরের মাজার হিসেবেই পরিচিত। ঐতিহাসিক এই মাজার ও মসজিদ দেখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসেন পর্যটকেরা।
তবে দীর্ঘ সময় সংস্কার না হওয়ায় একদিকে মাজারটি হারাতে বসেছে তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব, অন্যদিকে কমেছে পর্যটকসংখ্যা। পুরাকীর্তি হিসেবে এর নাম নেই খোদ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাতেও।
শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে শিবরামপুর এলাকায় মাজারটির অবস্থান। এখানে সালু কাপড়ে ঢাকা রয়েছে ৪০ হাত লম্বা একটি কবর। কবরে শুয়ে আছেন এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে আসা ৪০ জন ধর্মসাধক। চেহেল শব্দটি ফারসি, যার অর্থ চল্লিশ।
মাজার ঘেঁষে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে চেহেলগাজী মসজিদ। ১৮৪৭ সালে দিনাজপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ওয়েস্ট মেকট চেহেলগাজী মসজিদ থেকে তিনটি শিলালিপি উদ্ধার করেন।
যার একটি দিনাজপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। শিলালিপি থেকে জানা যায়, ৮৬৫ হিজরির ১৬ সফর (১৪৬০ সালের ১ ডিসেম্বর) মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। সে সময় মাজারটিরও সংস্কারকাজ করা হয়। সুলতান রুকনুদ্দিন বারবক শাহের রাজত্বকালে (১৪৫৯-১৪৭৪) তাঁর উজির ইকরাব খানের নির্দেশে পূর্ণিয়া জেলার অন্তর্গত জোর ও বারুক পরগনার শাসনকর্তা উলুঘ নুসরত খান মসজিদটি নির্মাণ করেন।
এত বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে, এমন একটি নিদর্শন পুরাকীর্তির তালিকায় না থাকায় অবাক হয়েছে জেলার সুধীসমাজ। বিষয়টি নিয়ে উল্লেখ করার মতো গবেষণাকাজও হয়নি এতকাল। প্রত্নতত্ত্ব আইন-২০১৫-তে বলা হয়েছে, ঐতিহাসিক, জাতিতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক, সামরিক অথবা বৈজ্ঞানিক মূল্যসমৃদ্ধ যেকোনো প্রাচীন নিদর্শন বা স্থান ১০০ বছরের পুরোনো হলেই তা প্রত্নসম্পদের আওতাভুক্ত হবে। কিন্তু দিনাজপুরের চেহেলগাজী মাজার ও মসজিদ সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রংপুর-রাজশাহী বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরাকীর্তির অংশ হওয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিভিন্ন সময় জরিপের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ এসব স্থাপনার সন্ধান পেলে দাপ্তরিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। দিনাজপুরে এখনো জরিপ শেষ হয়নি। বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। শিগগিরই স্থাপনাটি পরিদর্শন করা হবে। প্রত্নতত্ত্বের আওতায় আসার উপাদান থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সম্প্রতি মসজিদ ও মাজার প্রাঙ্গণ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাজারসংলগ্ন তিনটি বাঁধানো কবর। প্রাচীন মসজিদটির পাশেই আরও একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। উত্তর-পশ্চিম অংশে এবং পূর্ব দিকে দুটি পুকুর। পুকুরের পাশ ঘেঁষে কবরস্থান। মাজারে প্রবেশের ডান দিকে একটি হাফেজি মাদ্রাসাও রয়েছে। পশ্চিম প্রান্তে ছোট একটি শালবন। প্রায় সাড়ে ১১ একর জমিজুড়ে মাজার-মসজিদ-কবরস্থান এলাকাটিতে সুনসান নীরবতা। দেখা গেল, মাজারটির ছাদ থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। স্যাঁতসেঁতে নোনা ধরা দেয়ালে জমেছে শেওলা।
বর্তমানে মসজিদটির অবশিষ্ট বলতে চারটি দেয়াল। বর্গাকার মসজিদটির সামনে বড় একটি দরজা ভেদ করে বারান্দা। এরপর সামনের দিকে তিনটি দরজা এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে মোট দুটি দরজা। একসঙ্গে ৩০-৩৫ জন নামাজ আদায় করতে পারেন। টিকে থাকা মেহরাবটির কাছে কিছু পোড়ামাটির ফলক রয়েছে। পোড়ামাটির ফলকগুলোতে রয়েছে ফুল, লতাপাতাসংবলিত কিছু টেরাকোটা। ভগ্নদশায় সেসব পোড়ামাটির ফলক। সাম্প্রতিক সময়ে মসজিদের ওপরে একটি টিনের ছাউনি দেওয়া হয়েছে।
মসজিদ ও মাজার দেখতে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা আসেন। তবে বর্তমানে দর্শনার্থীর সংখ্যা কমেছে। পুরোনো মসজিদটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং মুসল্লির সংখ্যা বেশি হওয়ায় পাশেই আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ পাঁচ সদস্যের একটি কমিটির মাধ্যমে মাজার ও মসজিদ পরিচালিত হচ্ছে।
চেহেলগাজী মাজার বিষয়ে দিনাজপুর অঞ্চলের লোকসংস্কৃতি গবেষক ও বীরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মাসুদুল হক বলেন, ইতিহাস সচেতনতার অভাবে চেহেলগাজী মাজারের ৮০ শতাংশ অংশের ক্ষতিসাধন হয়েছে। এখন যতটুকু অবশিষ্ট আছে, সেটুকু যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। চেহেলগাজী মাজার ও মসজিদটি নিয়ে যথেষ্ট গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।