জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না, যাকে ধরেন, খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন : হাইকোর্ট

হাইকোর্ট ভবনফাইল ছবি

‘জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না’—আজ সোমবার এক শুনানিতে এ মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘কথিত আটক’ ছয়জন সমন্বয়ককে অবিলম্বে মুক্তি দিতে ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালাতে নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে হাইকোর্ট এ মন্তব্য করেন।

বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে আজ বেলা দেড়টার দিকে ওই রিটের ওপর শুনানি শুরু হয়।

শুনানির একপর্যায়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, ‘গতকাল টিভিতে দেখেছি, এই ছয়জন (সমন্বয়ক) কাঁটাচামচ দিয়ে খাচ্ছে।’

একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘এগুলো করতে আপনাকে কে বলেছে? কেন করলেন এগুলো? জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না। যাকে নেন ধরে, একটি খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন।’

এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘কথিত আটক’ ছয় সমন্বয়ককে অবিলম্বে মুক্তি দিতে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালাতেও নির্দেশনা চেয়ে আজ রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী। তাঁরা হলেন আইনজীবী মানজুর-আল-মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা।

রিটের শুনানিতে যেসব বিষয় উঠে এল

শুরুতে আবেদনকারী মানজুর–আল–মতিন বলেন, নিরাপত্তার জন্য তাঁদের (ছয়জন) হাসপাতাল থেকে তুলে আনা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে এসেছে। তাঁদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়ার ছবি দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের আটক রেখে সেই ছবি দেওয়া হচ্ছে। ছয়জনকে দিয়ে বিবৃতি দেওয়ানো হচ্ছে। এর আগে একজনকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়েছে। তাঁর ক্ষতবিক্ষত শরীরের ছবি দেখেছি। তিনি বলেন, ‘আমরা সমাজে বাস করি।…ইন্টারনেট কেন বন্ধ ছিল?’

এ সময় রিট আবেদনকারীর উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘রাজনৈতিক অনেক ইস্যু আছে, তা এনে কোর্টকে নষ্ট কইরেন না।’

আরও পড়ুন

রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী অনীক আর হক বলেন, ‘আক্রমণ হলে পিআরবি (বাংলাদেশ পুলিশের প্রবিধান) অনুসারে পুলিশ আত্মরক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিতে পারে। শিশু, শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে তাজা গুলি চালানো হয়েছে, যা পিআরবি সমর্থন করে না। তাজা গুলির কারণে প্রাণহানি হতে পারে। দেশের সম্পদ নষ্ট হোক আমরা তা চাই না। এই শিক্ষার্থীরা কি দেশের সম্পদ নয়? গুলিতে তাদের কারও প্রাণহানি হলে কি দেশের সম্পদ নষ্ট হয় না? তাদের ছত্রভঙ্গ বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অনেক পদ্ধতি আছে। শুধু তাজা গুলি ছোড়ার বিষয়েই বলেছি।’ তিনি বলেন, ‘তবে কিছু হলে পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখবে, তা নয়। পুলিশ কিছু করবে না বা তাদের থামিয়ে দিতেও বলা হচ্ছে না। আজকে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কথা বলি, সব কটিই আমাদের সম্পদ। যে প্রাণগুলো গিয়েছে, তারা কি আমাদের সম্পদ নয়।’

রিটের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ছয়জনকে তুলে নেওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে। কাউকে নিরাপত্তার স্বার্থে তুলে নেওয়া যায় না। জাতির সামনে টিভিতে ডিবি একাধিকবার বলেছে যে তাদের কাছে রাখা হচ্ছে, তাদের হেফাজতে। তারাই বলেছে নিরাপত্তার স্বার্থে। কোনো বইয়ে, সংবিধানে নেই—এ কারণে কাউকে তুলে নেওয়া যায়। সে জন্য তাদের (ছয়জন) যেন আদালতের সামনে হাজির করা হয় অথবা মুক্তি দেওয়া হয়, তা চাওয়া হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম দিয়ে যে কাজ করা হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। রাতে ব্লক রেইড দেয়, পত্রপত্রিকায় এসেছে। ’৭১–এ যেটি হয়েছিল। এখানে কোনো মুক্তিযোদ্ধা আছে কি না, দরজায় নক করে বলা হতো। আর ২০২৪ সালে দেখলাম দরজায় নক করে বলে, এখানে কোনো ছাত্র আছে কি না। ছাত্র থাকলে মুঠোফোনটা নেয়। মুঠোফোন নিয়ে তা চেক করে—এটা কোন আইনে পেয়েছে? ব্লক রেইড দিয়ে যেটি করে রাতের বেলায়—এটা কি আইন সম্মত?

তারা কি নিশ্চয়তা দিতে পারবে আর হামলা হবে না

শুনানিতে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, যথাযথ আকারে রিটটি করা হয়নি। নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কী করবে, তা তাদের বিষয়। পরিস্থিতির ওপর তা নির্ভর করবে। রিট আবেদনকারীরা কি নিশ্চয়তা দিতে পারবে বিটিভি ভবনে আর হামলা হবে না, সেতু ভবনে এক শ গাড়ি পোড়াবে না ও মেট্রোরেলে হামলা হবে না? রিটে শিক্ষার্থীদের ওপর যাতে গুলি না ছোড়ে, তা বলা হয়েছে। এই প্রার্থনা সবার জন্য। তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সারা দেশে অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তকারীদের বিরুদ্ধে কী বলপ্রয়োগ করতে পারবে না? এটি কিসের ইঙ্গিত? বেআইনিভাবে কেউ কিছু করলে অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে ও শাস্তি হবে।

মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, তাদের (ছয়জন) জীবনের নিরাপত্তার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিরাপত্তা দিচ্ছে। তাদের পরিবারের কেউ এখানে আসেনি। যে আকারে রিট করা হয়েছে, তা যথাযথ হয়নি। এই রিট আবেদনে কোনো রুল ইস্যু করা যায় না।

অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ শুনানিতে বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আইনগত ক্ষমতা অবৈধ প্রয়োগের মাধ্যমে এই এই লোক মারা গেছেন বা আহত হয়েছেন—এমন কিছু রিটে উল্লেখ নেই। রিটে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। ছয়জনের ক্ষেত্রে কোনো আটকাদেশ দেওয়া হয়নি।

অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, কোথাও নেই তাদের আটকাদেশ দেওয়া হয়েছে। যদি গ্রেপ্তার করা হতো, তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের আদালতে হাজির করার বিষয় আসত।

উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত আগামীকাল পরবর্তী দিন রাখেন। এর আগে আদালত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজহার উল্লাহ ভূইয়ার বক্তব্যও শোনেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় উপস্থিত ছিলেন।

পরে আজ রাতে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, আগামীকাল মঙ্গলবারের কার্যতালিকায় রিটটি আদেশের জন্য ১০ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে।