ডিমের উৎপাদনের হিসাবে গরমিল
সরকার বলছে, উৎপাদন বেড়েছে। বেসরকারি খাত বলছে, কমেছে। দাম বাড়তি, দরিদ্র মানুষের পাতে উঠছে না ডিম।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার রাজাবাড়ী গ্রামের নবাব আলী পেশায় একজন ভ্যানচালক। মা, স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। দুটি বড় হাঁস আছে জানিয়ে নবাব আলী বলেন, ‘দুই-তিন মাস আগে আঁশে (হাঁস) ছয়-সাতটা ডিম দিছিল। তারপর আর ডিম দিছে না। আঙ্গর কিইন্না (কিনে) খাওয়ার সামর্থ্য নাই।’
নবাব আলী ও তাঁর পরিবারের মতো স্বল্প আয়ের বহু মানুষের পাতে এখন আর ডিম পড়ে না বললেই চলে। অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়ায় অনেকেই ডিম কিনে খেতে পারছেন না।
বাস্তবতা যখন এমন, তখন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, প্রতিবছরই ডিমের উৎপাদন বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট লোকজন বলছেন, উৎপাদন বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই দাম কমে আসে। অথচ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ডিমের বাড়তি উৎপাদন দেখালেও দাম বেড়েই চলেছে। ফলে অধিদপ্তরের হিসাবে গলদ আছে।
প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা জানেন যে আমার এতগুলো মুরগি আছে। তবে উৎপাদন যে কতটুকু হচ্ছে, এটা তাঁরা জানেন না। কখনো জিজ্ঞেসও করেন না। কখনো আসেনও না।
দেশে কী পরিমাণ দুধ, ডিম ও মাংস উৎপাদিত হয়, তার হিসাব প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাসিক ও বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকে। তাদের হিসাব বলছে, দেশে প্রতিবছর ডিমের উৎপাদন বেড়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যেখানে দেশে ১ হাজার ৫৫২ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়েছে, সেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে হয়েছে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ডিম।
অধিদপ্তর সর্বশেষ মাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এ বছরের জুলাই মাসে। তাতে দেখা গেছে, পাঁচ মাস (মার্চ-জুলাই) ধরে ডিমের উৎপাদন বাড়ছে। মার্চে যেখানে উৎপাদন ছিল প্রায় ১৫৯ কোটি, জুলাই মাসে সেখানে হয়েছে প্রায় ২১০ কোটি ডিম।
কেবল তা-ই নয়, চলতি বছরের জুলাইয়ে যে পরিমাণ ডিম উৎপাদিত হয়েছে, তা সর্বশেষ চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে যেখানে ডিমের উৎপাদন ছিল ১৪০ কোটির বেশি, চলতি বছরের জুলাইয়ে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ২১০ কোটি।
ডিম উৎপাদনের ভিন্ন তথ্য তুলে ধরছে এই খাতের বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মস। তাদের হিসাবে, ২০২২ সালের জুন মাস থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশে ডিম উৎপাদন কমছে। চলতি বছরের মার্চ থেকে জুলাই মাসেও ধারাবাহিকভাবে কম ডিম উৎপাদিত হয়েছে। কাজী ফার্মসের হিসাবে, চলতি বছরের মার্চে দেশে ১১৮ কোটি ডিম এবং জুলাইয়ে হয়েছে প্রায় ১১৬ কোটি ডিম; অর্থাৎ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জুলাইয়ে ডিম উৎপাদনের যে হিসাব দিয়েছে, তার অনেক কম উৎপাদনের কথা বলছে কাজী ফার্মস।
সরকারি হিসাবে, ডিমের উৎপাদন বাড়ছে। বেসরকারি হিসাবে, কমছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এমন বিপরীতমুখী তথ্যের মধ্যে দেশে ডিমের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। পুষ্টিকর এই খাবার চলে গেছে স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর যে হিসাব প্রকাশ করে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে খোদ ওই অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যেই। নাম না প্রকাশের শর্তে এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব মনগড়া। সঠিক হিসাব না থাকায় সরকার আগাম কৌশল গ্রহণ করতে পারে না। সরকার যদি আগাম জানতে পারত এই পরিমাণ ডিমের ঘাটতি থাকবে, তাহলে উৎপাদন বাড়িয়ে কিংবা আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করতে পারত। তা না হওয়ায় বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। আর এর সুবিধা ভোগ করছে এই খাতের বড় বড় প্রতিষ্ঠান।
ডিম উৎপাদনের ভিন্ন তথ্য তুলে ধরছে এই খাতের বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মস। তাদের হিসাবে, ২০২২ সালের জুন মাস থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশে ডিম উৎপাদন কমছে। চলতি বছরের মার্চ থেকে জুলাই মাসেও ধারাবাহিকভাবে কম ডিম উৎপাদিত হয়েছে।
হিসাবে যত সংকট, গরমিল
মাঠপর্যায় থেকে দুধ, মাংস ও ডিমের তথ্য সংগ্রহ করে প্রতি মাসে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের কাছে পাঠান উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা তা পাঠান বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কাছে। আর বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা তা পাঠান প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে। এরপর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর তা প্রকাশ করে থাকে। মূলত এভাবেই হিসাব হয়ে থাকে দুধ, ডিম ও মাংস উৎপাদনের।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপজেলা কার্যালয়ে সাধারণত একজন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ও একজন ভেটেরিনারি সার্জন থাকেন। সার্জনের কাজ গবাদিপশুর চিকিৎসা করা, তিনি তা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। কোনো কোনো উপজেলায় সার্জনও থাকেন না।
প্রশাসনিক কাজ, সভা, প্রকল্পের কাজসহ সব ধরনের কাজ করে একজন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার পক্ষে প্রতি মাসে সেই উপজেলায় কী পরিমাণ দুধ, ডিম ও মাংস উৎপাদিত হয়, তা যথাযথ হিসাব করা কতটা সম্ভব, এ নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট লোকজন। এক কর্মকর্তা বলেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা যে তথ্য পাঠান, তা বাস্তবসম্মত নয়। অনুমাননির্ভর।
দুজন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জানান, উপজেলায় কী পরিমাণ ডিম পাড়া মুরগি ও হাঁস আছে, সেই তথ্য তাঁদের কাছে আছে। সেই সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে যে হাঁস-মুরগি আছে, সেই তথ্যও আছে। এসব হাঁস-মুরগি কী পরিমাণ ডিম দিতে পারে, তার একটা হিসাব আছে। সেই হিসাব ধরে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এ ছাড়া ডিমের আড়ত থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। টেলিফোনেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা খামারিদের কাছ থেকে তথ্য নেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বনখরি গ্রামের খামারি আলী আকবর সাত হাজার ডিম পাড়া মুরগি পালন করেন। প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার মুরগি ডিম দেয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন,‘ প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা জানেন যে আমার এতগুলো মুরগি আছে। তবে উৎপাদন যে কতটুকু হচ্ছে, এটা তাঁরা জানেন না। কখনো জিজ্ঞেসও করেন না। কখনো আসেনও না।’
আবার অনেক খামারি লোকসান দিয়ে খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। যে তথ্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানেন না। এতেও ভুল হিসাব তৈরি হয় বলে মনে করেন খামারিরা।
এ ছাড়া প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর যে হিসাব প্রকাশ করে, তাতে গরমিল রয়েছে। উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো একটি সুনির্দিষ্ট মাসের দুধ, ডিম, মাংসের তথ্য প্রকাশ করা হলেও আসলে সেখানে সেই মাসের তথ্য থাকে না। যেমন জুলাই মাসে দেশে ২০৯ কোটি ৯৩ লাখ ডিমের উৎপাদন হয়েছে। আসলে এখানে জুন মাসের শেষের ১৫ দিন এবং জুলাই মাসের প্রথম ১৫ দিনের তথ্য রয়েছে। জুন ও জুলাই মাসের তথ্যকে জুলাই মাসের তথ্য হিসেবে আগস্ট মাসের শুরুর দিকে প্রকাশ করা হয়।
কর্মকর্তারা জানান, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা প্রতি মাসের ১৫ থেকে ১৮ তারিখের মধ্যে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কাছে দুধ, ডিম, মাংসসহ অন্যান্য তথ্য পাঠান। ফলে প্রতি মাসের প্রথম ১৫ দিন এবং তার আগের মাসের শেষের ১৫ দিনের তথ্য সেখানে থাকে। প্রতি মাসে হিসাব এভাবেই তৈরি হয়।
জেলা পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সামনে এমন থাকবে না। পদ্ধতি ডিজিটাল করা হচ্ছে। তখন যে মাসের তথ্য, সে মাস হিসেবেই দেখানো সম্ভব হবে।
অবশ্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ রেয়াজুল হক প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, তাঁদের তথ্যই নির্ভরযোগ্য।
দাম বাড়ছে কেন
বছর বছর ডিমের দাম বেড়েই চলেছে। সরকারের ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের ৩০ জুলাই এক হালি ডিমের দাম ছিল ২৮-৩৩ টাকা। ২০২২ সালের ৩০ জুলাই তা ছিল ৪০-৪২ টাকা। আর চলতি বছরের ৩০ জুলাই এক হালি ডিম বিক্রি হয় ৪৮-৫০ টাকায়।
৪ সেপ্টেম্বর কারওয়ান বাজারের পাইকারি দোকানে গিয়ে দেখা যায়, এক হালি ডিম ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে দাম আরও বাড়তি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ডিম উৎপাদন বেড়েছে। বাজারে সরবরাহ বেশি থাকলে দাম বাড়ছে কেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক রেয়াজুল হক বলেন, ডিমের দাম বেড়েছে ভিন্ন কারণে। বর্তমান সময়ে সবজির উৎপাদন একেবারেই কম। এর চাপ পড়ে ডিম ও ব্রয়লারের ওপর।
ব্যবসায়ীরা বলছেন অন্য কথা। তাঁরা বলছেন, খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় খামারিরা লোকসানের মুখে মুরগি পালন বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে ডিমের উৎপাদন কমে গেছে।
৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপন বার্তায় কাজী ফার্মস দেখিয়েছে, দেশে অব্যাহতভাবে ডিমের উৎপাদন কমছে। সেখানে কাজী ফার্মসের পরিচালক জিসান হাসান বলেছেন, এক বছরে ডিমের উৎপাদন কমেছে ১৪ শতাংশ। কারণ, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লেয়ার ফার্মার (ডিম উৎপাদনকারী খামারি) ডিম উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। দাম বাড়ায় খামারিরা খাদ্য কিনতে পারছিলেন না। কিন্তু ডিমের চাহিদার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে শস্যের দাম বাড়ায় খাদ্যের দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এতে ডিমের উৎপাদন খরচ বেড়েছে বলেও উল্লেখ করেন জিসান হাসান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, খাদ্য উৎপাদন খরচ করোনার আগে যা ছিল, তার চেয়ে ১০-১২ টাকা করে বেড়েছে কেজিতে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা খাদ্য উৎপাদন খরচ প্রায় দ্বিগুণ দেখাচ্ছেন। তাঁরা বাড়তি খরচ দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিচ্ছেন। তাঁরা খাদ্যের বাড়তি উৎপাদন খরচ দেখিয়ে ডিম ও মাংসের বাড়তি দাম জায়েজ করছেন।
খাদ্যের বাড়তি দামের কারণে প্রান্তিক খামারিদের একটা অংশ উৎপাদন ছেড়ে দেওয়ায় ডিমের দাম বেড়েছে বলে মনে করেন প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার। তিনি বলেন, প্রান্তিক খামারিদের সঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সম্পর্ক কম। তাদের সম্পর্ক বেশি করপোরেট খামারিদের সঙ্গে। ফলে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের পক্ষে ডিম উৎপাদনের সঠিক তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়।