আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলা, ঢাকার কড়া প্রতিবাদ

  • হাইকমিশনে ঢুকে বাংলাদেশের পতাকা অবমাননা-ভাঙচুর।

  • কয়েক দিন ধরে আগরতলায় বিক্ষোভ ও সমাবেশ করছিলেন হিন্দুত্ববাদীরা।

  • এ হামলা কূটনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক ভিয়েনা সনদের লঙ্ঘন।

  • অন্যান্য উপ ও সহকারী হাইকমিশনের নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ দিল্লির।

ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে সোমবার বিক্ষোভ করেন হিন্দু সংঘর্ষ সমিতির সমর্থকেরা ছবি: সংগৃহীত

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় গতকাল সোমবার বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে ঢুকে হামলা চালানো হয়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিন্দু সংঘর্ষ সমিতিসহ কয়েকটি সংগঠনের সমর্থকেরা এ হামলা চালান। এদিন মুম্বাইয়ের বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের কাছাকাছি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) আয়োজনে কয়েক শ লোক বিক্ষোভ করেছেন। হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি হলো ভিএইচপির সহযোগী সংগঠন।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগরতলার ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছে। তারা বলেছে, কূটনৈতিক ও কনস্যুলার সম্পত্তি কোনো অবস্থাতেই লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং দেশের (ভারতের)

অন্যান্য স্থানে তাদের উপ ও সহকারী হাইকমিশনের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার জন্য সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে।

তবে আগরতলার হামলার বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত উল্লেখ করে নিন্দা ও কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হামলার ঘটনা বাংলাদেশ সরকারকে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। ঘটনাপ্রবাহ দেখে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে হামলাটি পূর্বপরিকল্পিত। এ ঘটনা কূটনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক ভিয়েনা সনদের লঙ্ঘন। এ ছাড়া ওই হামলার ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গতকাল রাতে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

কয়েক দিন ধরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে। গত রোববার ফেনীর সীমান্তবর্তী পরশুরামের বিলোনিয়া স্থলবন্দরের ভারত অংশে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। সনাতনী হিন্দু সমাজের ব্যানারে কিছু ভারতীয় ওই বিক্ষোভ করেন। এ ঘটনায় গতকাল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এর আগে ২৮ নভেম্বর বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণ নামের একটি সংগঠন কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের সামনে সহিংস বিক্ষোভ করে। এ সময় তারা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও প্রধান উপদেষ্টার কুশপুত্তলিকা পোড়ায়। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে বাংলাদেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে। আর গতকাল পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বাংলাদেশে শান্তিসেনা পাঠাতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানাতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আরজি জানান।

৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। ওই দিনই শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। ভারতের অভিযোগ, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চলছে। এরই মধ্যে গতকাল ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সংখ্যালঘু পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছে বাংলাদেশ। সেখানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, দেশের পরিস্থিতি নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি গোষ্ঠী।

আগরতলার সহকারী হাইকমিশনে হামলা

কলকাতা থেকে প্রথম আলোর সংবাদদাতা জানান, আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হিন্দু সংঘর্ষ সমিতিসহ কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হামলা চালায়। তারা সহকারী হাইকমিশনের প্রাঙ্গণে ঢুকে বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে তাতে আগুন দেয় এবং সেখানে ভাঙচুর করা হয়।

কয়েক দিন ধরে হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠন আগরতলা এবং সংলগ্ন অঞ্চলে বিক্ষোভ, সমাবেশ ও মিছিল করছে। গতকাল দুপুরে তারা হঠাৎ সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়ে বলে ওই সাংবাদিক জানান।

ত্রিপুরার পর্যটনমন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী ঘটনাটিকে ‘অত্যন্ত দুঃখজনক’ বর্ণনা করে বলেন, ‘এটাও মনে রাখতে হবে, এটা কিন্তু দীর্ঘদিনের ক্ষোভের প্রকাশ।’

আগরতলা থেকে কূটনৈতিক সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ও চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে গতকাল বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। সংঘ পরিবারভুক্ত বিভিন্ন সংগঠন, ভিএইচপির হিন্দু সংঘর্ষ সমিতি, বজরং দল ও হিন্দু জাগরণ মঞ্চের নেতৃত্বে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল সকাল থেকে সহকারী হাইকমিশনের ৫০০ মিটার অদূরে এই বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করা হয়। বেলা একটার দিকে বিক্ষোভ সমাবেশের একাংশ হাইকমিশনের দিকে এগোতে থাকে। একপর্যায়ে তারা বাধা পেরিয়ে হাইকমিশনের মূল ফটকের সামনে পৌঁছে বিক্ষোভ করতে থাকে।

সূত্র জানায়, বিক্ষোভের একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের প্রতিনিধিদল স্মারকলিপি দিতে মিশনে প্রবেশ করে। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে মিশনের মূল ফটকের বাইরে থাকা বিক্ষোভকারীরা জোর করে মিশন চত্বরে প্রবেশ করে। এরপর তারা ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড থেকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নামিয়ে পদদলিত করে এবং ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে পাশাপাশি ফুলের টব ভেঙে ফেলে। এ সময় সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্য উপস্থিত থাকলেও তাদের কোনো সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায়নি।

স্থানীয় পশ্চিম ত্রিপুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চিরঞ্জীব চক্রবর্তী ভারতের সংবাদমাধ্যম পিটিআইকে বলেন, হিন্দু সংঘর্ষ সমিতির ছয়জনের একটি প্রতিনিধিদল স্মারকলিপি দিতে মিশনে প্রবেশ করে। আর কিছু বিক্ষোভকারী মিশনের ভেতরে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে স্লোগান দিচ্ছিলেন।

আগরতলার হামলা পূর্বপরিকল্পিত: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনের প্রাঙ্গণে গতকাল হিন্দু সংঘর্ষ সমিতির বিক্ষোভকারীদের একটি বড় দলের হিংসাত্মক বিক্ষোভ ও হামলার ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার গভীরভাবে ক্ষুব্ধ।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রাপ্ত ঘটনাপ্রবাহ চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে, বিক্ষোভকারীদের পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের প্রধান ফটক ভেঙে প্রাঙ্গণে আগ্রাসনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে তারা পতাকার খুঁটি ভাঙচুর করে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করে এবং সহকারী হাইকমিশনের ভেতরে সম্পত্তির ক্ষতি করে। পরিতাপের বিষয়, প্রাঙ্গণ রক্ষার দায়িত্বে থাকা স্থানীয় পুলিশ সদস্যরা শুরু থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ছিলেন না।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সহকারী হাইকমিশনের সব সদস্য প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বাংলাদেশ সরকার জোর দিয়ে বলতে চায়, বাংলাদেশের একটি কূটনৈতিক মিশনের ওপর এই জঘন্য হামলা এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অপবিত্রতা একটি নৈমিত্তিক উদাহরণ হয়ে উঠেছে। গত ২৮ নভেম্বর কলকাতায়ও একই ধরনের হিংসাত্মক বিক্ষোভ হয়েছে। আগরতলায় এই বিশেষ কাজটি কূটনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক ভিয়েনা সনদের লঙ্ঘন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কূটনৈতিক মিশনগুলোকে যেকোনো ধরনের অনুপ্রবেশ বা ক্ষতি থেকে রক্ষা করা স্বাগতিক দেশের সরকারের দায়িত্ব। তাই বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে এ ঘটনা মোকাবিলায় অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে এবং ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের যেকোনো ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ, কূটনীতিক ও অকূটনৈতিক সদস্য এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা জোরদার করতে ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

মুম্বাই মিশনের কাছে বিক্ষোভ

ভারতের মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বাইয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের কাছে গতকাল বিকেলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কয়েক শ বিক্ষোভকারী বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে বাংলাদেশ মিশনের এক শ থেকে দেড় শ গজের মধ্যে এসে অবস্থান নেন। তাঁরা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং ইসকন সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিবাদ জানিয়ে নানা স্লোগান দেন।

মুম্বাইয়ে বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের দূতাবাসপ্রধান মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, মুম্বাইয়ে এদিন শ তিনেক বিক্ষোভকারী আজাদ ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন। পরে তাঁরা সেখান থেকে সরে বাংলাদেশ মিশনের কাছে গিয়ে স্লোগান দেন ও পথসভা করেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আয়োজনে ওই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও বিশিষ্ট শিল্পপতি লোধা মঙ্গল প্রভাত।

জানা গেছে, সাধারণত বিদেশি কোনো মিশনের আশপাশে কোনো সমাবেশ হলে তা ওই দেশের মিশনকে স্বাগতিক দেশ জানিয়ে দেয়। কিন্তু মুম্বাইয়ের উপহাইকমিশন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ওই বিক্ষোভ সম্পর্কে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের কাছ থেকে প্রথম তথ্য পেয়েছিল। তবে স্থানীয় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের মিশনের কাছে পথ আটকে দেয়।