কে-টু জয়ের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা শোনালেন ওয়াসফিয়া
পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কে-টু বিজয়ী প্রথম বাঙালি ও বাংলাদেশি ওয়াসফিয়া নাজরীন। কাশ্মীরে অবস্থিত এই পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ অভিযাত্রীদের কাছে সবচেয়ে দুর্গম ও বিপৎসংকুল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। গত ২২ জুলাই কে-টু চূড়ায় পা রাখেন ৩৯ বছর বয়সী ওয়াসফিয়া। এ নিয়ে প্রথম বাঙালি ও বাংলাদেশি হিসেবে সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয় করার কৃতিত্ব গড়লেন তিনি।
বিশ্বের ১৪টি আট হাজারি শৃঙ্গের মধ্যে কে-টুর (৮৬১১ মিটার) অবস্থান মাউন্ট এভারেস্টের (৮৮৪৮ মিটার) পরই। পিরামিড আকৃতির এই পর্বত আরোহণে বেশির ভাগ জায়গায় খাড়াভাবে উঠতে হয়। এর ধাপে ধাপে পড়ে রয়েছে পর্বতারোহীদের মরদেহ।
দুর্গম এই পথ পাড়ি দিয়ে পর্বতশৃঙ্গে পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা আজ বুধবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে শোনালেন ওয়াসফিয়া। তিনি বলেন, কে-টু অভিযানে মানসিক জোর খুব বেশি জরুরি ছিল। অভিযানে গিয়ে একদণ্ড বসা বা জিরানোর উপায় ছিল না। পর্বতের ৮০ শতাংশ জায়গাই ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে রয়েছে। একটু এদিক-সেদিক হলেই সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।
ওয়াসফিয়া দ্বিতীয় বাংলাদেশি নারী হিসেবে ২০১২ সালের ২৬ মে এভারেস্ট জয় করেন। সংবাদ সম্মেলনে ওয়াসফিয়া বলেন, জীবন বাজি রেখে কে-টু অভিযানে গিয়েছিলেন। দলের প্রতিটি সদস্যের সার্বিক সহায়তায় তিনি জীবিত অবস্থায় অভিযান শেষ করতে পেরেছেন। তিনি বলেন, কে-টু অভিযান শেষ করে ফেরত আসার পথে নারীরা বেশি মারা যান। ১৯৫৪ সাল থেকে কে-টু শৃঙ্গে গিয়ে জীবিত ফিরে এসেছেন ৪০ জন নারী। তাঁদের একজন তিনি।
ওয়াসফিয়া বলেন, অভিযানের পথে পথে বইয়ে পড়া অনেক পর্বতারোহীর মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। তাঁদের দেখে শুধু মনে হয়েছে এর পরের জন হয়তো তিনি নিজে হবেন। হাত বের করে রাখা, চোখ খোলা (হুট করে দেখলে মনে হবে জীবিত), জুতা থেকে পা বের হয়ে যাওয়া অথবা মাথা ছাড়া শুধু শরীরটাই আছে। এ মৃতদেহগুলো ফেলে আসতে হয়েছে বলে মানসিক ট্রমাও কাজ করেছে। সে জন্য নেপালে ফিরে একজন চিকিৎসকেরও শরণাপন্ন হতে হয়েছে।
ওয়াসফিয়া জানালেন, বড় বরফের একটি টুকরা তাঁর মাথায় পড়েছিল। মাথায় হেলমেট ছিল বলে তিনি বেঁচে ফিরতে পেরেছেন। জানালেন, তিনি যখন লক্ষ্যে পৌঁছালেন তখন খুশিতে কান্না শুরু করেন। বড় একটি জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু গলা দিয়ে বলতে গেলে কোনো আওয়াজই বের হচ্ছিল না।
ওয়াসফিয়া আজই নেপাল থেকে দেশে ফিরেছেন। একবারেই কে-টু জয় করে ফেরত আসতে পেরেছেন এমন পর্বতারোহীদের মধ্যে রয়েছে তাঁর দল। বিখ্যাত তিন পর্বতারোহী মিংমা তেনজি শেরপা, মিংমা ডেভিড শেরপা ও নির্মল পুরজা এ অভিযানের নেতৃত্ব দেন। সংবাদ সম্মেলনে ওয়াসফিয়া তাঁর দলের প্রতিটি সদস্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। ১২ জনের দলে ওয়াসফিয়াসহ নারী পর্বতারোহী ছিলেন ৬ জন। একমাত্র বাংলাদেশি ছিলেন ওয়াসফিয়া। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পর্বতারোহণ এবং ট্রেকিং করার অনুমতি পান।
ওয়াসফিয়া বলেন, বাংলাদেশ যখন ৪০-এ পা দেয়, তখন তিনি সাত পর্বতশৃঙ্গ জয় করার যাত্রা শুরু করেন। বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তিতে কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। ১০ বছর আগে যখন এ নিয়ে চিন্তা করেন তখনই কে-টু অভিযানের বিষয়টি তাঁর মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। তারপর শুরু হয় নিজেকে প্রস্তুত করা। এর মধ্যে করোনা পৃথিবীর অনেক কিছু পাল্টে দেয়। তিনি নিজেও করোনায় নাজেহাল হয়ে পড়েছিলেন। কয়েক মাস আগে করোনায় বাবা, চাচাকে হারিয়েছেন। তবে দমে যাননি ওয়াসফিয়া।
সংবাদ সম্মেলনে কে-টু অভিযানের কথা যখন বলছিলেন, তখন ওয়াসফিয়ার চোখেমুখে ছিল খুশির ঝিলিক। তবে বাবা এ অভিযানের খবরটি জেনে যেতে পারলেন না, তা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন তিনি।
পর্বতারোহণে দেশের নারীদের আর তেমন দেখা যাচ্ছে না—এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ওয়াসফিয়া বলেন, শুধু নারী নয়, পুরুষের বেলাতেও প্রথম কথা হলো জীবন বাজি রেখে পথে নামতে হবে। পর্বতারোহণের বিষয়টিকে ভালোবাসতে হবে। নেশা থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, বান্দরবানে পাহাড়ে চড়ে সেলফি তোলা আর পর্বতারোহণের মধ্যে পার্থক্য আছে। পর্বতারোহণ মানেই অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। মেয়েদের ক্ষেত্রে জীবন বাজি রেখে এ কাজ করতে কতজন বাবা-মা উৎসাহী হবেন, তা-ও চিন্তার মধ্যে নিতে হবে। তবে নারীরা আগ্রহী হলে ওয়াসফিয়া সার্বিক সহায়তা করবেন বলে সংবাদ সম্মেলনে আশ্বাস দিয়েছেন।