রজতজয়ন্তীর উৎসবে জমকালো আয়োজন
চলার পথে রজতজয়ন্তীর মাইলফলক পেরিয়েছে প্রথম আলো। এবার সেই গৌরবের দীপ্তি স্পর্শ করল দেশের বিনোদনজগতের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজন মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠানও। স্বাভাবিকভাবেই অনলাইনের এই বাড়বাড়ন্তের কালে সংবাদপত্রের ভূমিকা, সাংবাদিকতার গুণমান, পত্রিকার বিপণনের বিষয়গুলো উঠে এসেছিল উপভোগ্য আঙ্গিকে। তার সঙ্গে ছিল বাদ–প্রতিবাদ, বিদ্যায়তনে সন্তানের প্রথম হওয়া থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে শীর্ষ স্থান অধিকারের জন্য যে মরিয়া চেষ্টা, ছিল সেই বিষয়গুলোও। আর জমকালো নাচের সঙ্গে গান, সরস কথোপকথন, অভিনয় ও পুরস্কার বিতরণের পালা যে থাকবেই, সে তো সবারই জানা।
এবার অনুষ্ঠান হলো উত্তরায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে ইউনাইটেড কনভেনশন সেন্টারের ‘দ্য গ্রেস’ মিলনায়তনে। এখানে এ আয়োজন এবারই প্রথম।
রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও উপস্থাপনা করেছেন জননন্দিত তারকা হানিফ সংকেত। উপস্থাপনায় বিশেষ পুরস্কার, আজীবন সম্মাননা, তারকা জরিপ, নবাগত ও সমালোচনা মিলিয়ে বিভিন্ন বিভাগে মোট ২২টি পুরস্কার দেওয়া হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রের স্বনামখ্যাত ব্যক্তিত্বরা বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টায়। তার আগেই বিনোদনজগতের তারকা ও আমন্ত্রিত অতিথিরা আসতে থাকেন। তারকাদের জন্য পেতে রাখা হয়েছিল লালগালিচা। সেখানে ছিল তাঁদের লাস্যময় পদচারণ। তাঁরা বহুল প্রতীক্ষিত এই আয়োজন নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানের সূচনায় মঞ্চে আসেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কথাশিল্পী আনিসুল হক। তাঁর আমন্ত্রণে মঞ্চে আসেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি প্রথম আলোর রজতজয়ন্তীর শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘বর্তমানে পৃথিবীতে যুদ্ধ ও নানা দুঃসংবাদের মধ্যেও আমাদের বিনোদনজগতের শিল্পীরা জীবনে আনন্দ জাগাতে অনেক ভালো কাজ করছেন। তাঁদের প্রতি সম্মান জানাতেই প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।’ এই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিল্পীদের আজীবন সম্মাননা জানানো হয়। তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখন আমাদের মাঝে নেই। নেই অনেক সুহৃদও। প্রথম আলো সম্পাদক তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও যাঁরা অনুষ্ঠানে এসেছেন তাঁদের শুভেচ্ছা জানান।
এরপর স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বলেন, বিনোদনজগতের শিল্পীরা অনেক পরিশ্রম করে সারা বছর কাজ করেন। কাজের স্বীকৃতি জানানোর মাধ্যমে তাঁদের অনুপ্রাণিত করার জন্য এই পুরস্কার। প্রথম আলোর সঙ্গে মেরিলের এই পথচলা অব্যাহত থাকবে।
এ পর্যায়ে মতিউর রহমান জানান, হানিফ সংকেত তাঁর জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির জন্য টানা আটবার মেরিল–প্রথম আলো সেরা উপস্থাপকের পুরস্কার পেয়েছিলেন। তারপর তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন এই বিভাগের সেরা পুরস্কার তিনি আর নেবেন না। তারপর থেকে সেরা উপস্থাপকের পুরস্কারের বিভাগটাও বাদ দেওয়া হয়। হানিফ সংকেত মেরিল-প্রথম আলোর পুরস্কার অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বেশিবার উপস্থাপনা করেছেন। এবার তাঁকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হবে। এ সময় মঞ্চে আসেন হানিফ সংকেত। মতিউর রহমান ও অঞ্জন চৌধুরী তাঁর হাতে বিশেষ পুরস্কার তুলে দেন।
এই পর্বের পরে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় সংবাদপত্র নিয়ে গানের সঙ্গে নাচ দিয়ে। ‘গ্রাম জনপদ শহরের কথা’ এই গানের সঙ্গে সমবেত নৃত্যের পরে মঞ্চে আসেন এবারের অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হানিফ সংকেত। পরে তিনি ডেকে নেন তাঁর সহযোগী অভিনয়শিল্পী নাজনীন নাহার নিহারকে। তিনি এই আয়োজনের গত ২৫ বছরের ঐতিহ্যের বিষয়টি দর্শকদের সামনে তুলে ধরেন।
এরপর আজীবন সম্মাননার পালা। প্রবীণ অভিনয়শিল্পী মাসুদ আলী খানের নাম ঘোষিত হলে দর্শকেরা করতালিতে তাঁকে অভিনন্দন জানান। মঞ্চের নেপথ্যের ডিজিটাল পর্দায় ভেসে ওঠে শিল্পীর কর্মময় জীবনের তথ্যচিত্র। তাঁর হাতে আজীবন সম্মাননা স্মারক তুলে দেন বরেণ্য শিল্পী ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবী। পাশে ছিলেন মতিউর রহমান ও অঞ্জন চৌধুরী।
এরপর কানে শুনতে না পাওয়া নিয়ে হানিফ সংকেত একটি মজার গল্প শোনালেন। তারপর যেই তিনি সমালোচক পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, অমনি তুমুল শোরগোল করে মঞ্চে চলে আসে মাজনুন মিজান ও জামিল হোসেনের নেতৃত্বে দুই দল শিল্পী। হাল আমলের পরম কাঙ্ক্ষিত বিষয় ‘ভিউ’ নিয়ে শুরু হলো তাঁদের বাগ্বিতণ্ডা। অবশেষে তাঁদের মধ্যে মীমাংসার গুরুদায়িত্ব নিয়ে মঞ্চে এলেন অভিনয়শিল্পী চঞ্চল চৌধুরী। ‘ভিউশিকারি’দের উত্তেজনা প্রশমিত হওয়ার পরে ছিল ওয়েব সিরিজের সমালোচক পুরস্কার। পর্দায় দেখানো হলো মনোনয়ন পাওয়া সিরিজের ক্লিপিং ও বিচারকদের নাম। সেরা সিরিজ, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালকের হাতে পুরস্কার তুলে দেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী।
পুরস্কারের ফাঁকে ভিন্নধর্মী পরিবেশনা
বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ভিন্নধর্মী পরিবেশনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে অনুষ্ঠান। এ পর্যায়ে মঞ্চে এলেন বাউলগানের শিল্পীরা। চিশতি বাউলের সঙ্গে পান্থ কানাই পরিবেশন করেন ‘যদি থাকে নসিবে’, সুকুমার বাউলের সঙ্গে অনিমেষ রায় শোনান, ‘বলব না গো আর কোনো দিন’ এবং শফি মণ্ডলের সঙ্গে ফজলুর রহমান বাবু জুড়ি বেঁধে গেয়ে শোনালেন ‘তিন পাগলের হইল মেলা’।
গানের পরে ছিল ওয়েব সিরিজের সেরা অভিনেতা–অভিনেত্রীর সমালোচক পুরস্কার। যথারীতি পর্দায় ক্লিপিং দেখানো হলো। পুরস্কার তুলে দিলেন বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পী দিলারা জামান।
পুরস্কার বিতরণ শেষ হলে এক ভিন্ন আমেজ সৃষ্টি হলো মঞ্চে। সংবাদকর্মীরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন তারকাদের সাক্ষাৎকার নিতে। কেউ সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন দর্শক আসনে বসা আফরান নিশো ও সাফা কবিরের, তো কেউ মঞ্চে ছুটছেন নায়িকা পরীমনির পেছনে। চমক সৃষ্টির জন্য তাঁরা সত্য–মিথ্যা মিলিয়ে সংবাদের উদ্ভট শিরোনাম দিতে থাকেন। অপসাংবাদিকতা থেকে মুক্তির উপায় কী, তা জানতে উপস্থাপক হানিফ সংকেত পরামর্শ নিতে মঞ্চে ডাকলেন সম্পাদক মতিউর রহমানকে। তিনি বললেন, সব সময় সৎ ও সতর্ক থাকতে হবে।
সব মিলিয়ে বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল এই পর্ব।
আবার পুরস্কার বিতরণের পালা। এবার সীমিত দৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্রের পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা ও অভিনেত্রী—চার বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।
এরপর আবার পরিবেশনা। হানিফ সংকেত তাঁর সরস বাচনভঙ্গিতে শোনালেন বাতাস নিয়ে একটি গল্প। তা শেষ হলে শুরু হলো বাতাস নিয়েই গান ‘বাবা রে চাচা রে আমারে বাঁচা রে’। এর সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনায় অংশ নিলেন জিয়াউল রোশান, তৌসিফ মাহবুব ও শরীফুল রাজ।
চলচ্চিত্র ও ওয়েব ফিল্মের সমালোচনা বিভাগের চারটি পুরস্কার ঘোষণা করলেন উপস্থাপক। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে মঞ্চে এলেন নারী উদ্যোক্তা ও বিজিএমইএর প্রথম নারী সভাপতি রুবানা হক। পুরস্কার বিতরণীর পরে ভাওয়াইয়া ‘আবো নওদারীতা মরিয়া’, ‘রাঙামাটির রঙে চোখ জুড়াল’ এবং ‘সূর্যোদয়ে তুমি’সহ চার ধরনের গানের চার রকম নৃত্য পরিবেশন করেন তাসনিয়া ফারিণ, মেহজাবীন চৌধুরী ও সাবিলা নূর।
নাচের রেশ না কাটতেই ঘোষণা করা হলো তারকা জরিপ পুরস্কার। সেরা নবাগত অভিনয়শিল্পী ও বিজয়ী সংগীতশিল্পীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন নন্দিত সংগীতশিল্পী খুরশীদ আলম।
গান হলো, নাচও হলো খানিক আগেই। এবার তো কিছু ব্যতিক্রম প্রয়োজন। সেই ব্যবস্থাও রেখেছিলেন হানিফ সংকেত। মঞ্চে এবার অভিনীত হলো ‘প্রথম হতে চাওয়া’ নিয়ে একটি বিশেষ পরিবেশনা। বাবা চান ছেলে প্রথম হবে। এই প্রথম হওয়া নিয়ে মিশা সওদাগর ও সুমন পাটোয়ারী, মীর সাব্বির ও নাসির উদ্দিন খান এই পর্বে অংশ নেন। কথায় কথায় এল পদ্মা সেতুতে কে প্রথম হেঁটে পার হয়েছেন, কে প্রথম মেট্রোরেলে হেলান দিয়ে সেলফি তুলেছেন—এসব। শেষে মীমাংসার দায়িত্ব বর্তাল উপস্থাপকের ওপরেই।
এরপর ছিল তারকা জরিপের সীমিত দৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র ও ওয়েব সিরিজের অভিনেতা–অভিনেত্রীর পুরস্কার। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।
হিংসা–বিদ্বেষের এই যুগে সম্প্রীতির এখন বড় প্রয়োজন। তরুণ প্রজন্মের ১০ শিল্পীকে নিয়ে সম্প্রীতির গান ‘এসো সবাইকে ভালোবেসে ডাকি’ গেয়ে শোনালেন বিশিষ্ট শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী। তাঁর সহশিল্পীরা ছিলেন শাব্বির জামান, কিশোর দাস, অপু আমান, ইমরান মাহমুদুল, অয়ন চাকলাদার, মালিহা তাবাসসুম খেয়া, জিনিয়া জাফরিন লুইপা, অবন্তি সিঁথি, সিঁথি সাহা ও আতিয়া আনিসা।
শেষের আগে
পুরস্কার দেওয়ার পালা শেষ হয়েছিল তারকা জরিপে চলচ্চিত্র ও ওয়েব ফিল্মের বিজয়ীদের দিয়ে। তাঁদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন নন্দিত নায়ক আলমগীর।
এবার ফিরে যাওয়ার পালা। সামনে সম্ভাবনাময় জীবন, সংকট–সমস্যা থাকবে না, এমনও নয়। কিন্তু জীবন কি থেমে থাকে কখনো? জীবন সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যায়। শুরু হয়েছিল সংবাদপত্রের হকারদের গান দিয়ে, শেষ হলো হকারদের নিয়ে তেমনই একটি গানের সঙ্গে সমবেত নৃত্য দিয়ে। শিবলী মহম্মদ ও শামীম আরা নীপার নেতৃত্বে নৃত্যাঞ্চলের শিল্পীরা ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’ গানের সঙ্গে প্রথম আলো পত্রিকার বড় আকারে ডিজিটাল প্রিন্টের সঙ্গে সমসাময়িক ঘটনা মিলিয়ে এক চমৎকার পরিবেশনা উপহার দিলেন দর্শকদের। সেই গানের সুর, নাচের ছন্দ আর মন ভরানো আনন্দের রেশ নিয়ে ঘরের পথে ফেরেন দর্শকেরা।