‘একদিন আমার সফলতার গল্প লিখবেন আপনারা’
২ মাস ২০ দিন পর দ্বিতীয়বারের মতো মেয়েটির বাসায় যাওয়া হলো। প্রথমবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ছিল। আবহাওয়ার মতোই মন ভারী ছিল মেয়েটির। পড়াশোনার খরচ কীভাবে চলবে, কীভাবে নিজেরা চলবেন, তা নিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা। আর দ্বিতীয়বার সেই বাড়িতে গিয়ে মেয়েটিকে দেখা গেল ভিন্নভাবে। তাঁর মধ্যে আজ ‘কিছু একটা হওয়ার’ আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। মেয়েটির নাম তানজিলা আক্তার শিলা (২১)। ১১ বছর বয়সে আগুনে তাঁর সারা শরীর পুড়ে যায়। ডান পা কেটে ফেলতে হয়। তাঁকে নিয়ে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাঁর জীবিকার ব্যবস্থা হয়েছে। পড়ালেখা অব্যাহত রাখার জন্য তিনি পেয়েছেন প্রথম আলো ট্রাস্টের চার বছরের শিক্ষাবৃত্তি।
রাজধানীর গুলশান কমার্স কলেজ থেকে তানজিলা এবার জিপিএ-৪ পেয়ে বাণিজ্য বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তানজিলার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল গত বছরের ৮ অক্টোবর নারী অ্যাম্পুটি ফুটবলের ক্যাম্পে। যৌথভাবে স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স (শি) এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি) অঙ্গহানি হয়েছে, এমন নারী-পুরুষদের জন্য পাঁচ দিনব্যাপী ওই ফুটবল প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিল।
রাজধানীর গুলশান কমার্স কলেজ থেকে তানজিলা এবার জিপিএ-৪ পেয়ে বাণিজ্য বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তানজিলার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল গত বছরের ৮ অক্টোবর নারী অ্যাম্পুটি ফুটবলের ক্যাম্পে। যৌথভাবে স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স (শি) এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি) অঙ্গহানি হয়েছে, এমন নারী-পুরুষদের জন্য পাঁচ দিনব্যাপী ওই ফুটবল প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিল।
খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসা ও অনটনের মধ্যে লড়াই করে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া তানজিলার গল্প আরও গভীরভাবে শোনার জন্য প্রথমবার তাঁদের বাসায় যাওয়া হয়েছিল গত বছরের ১৮ অক্টোবর। আর দ্বিতীয়বার যাওয়া হলো ৮ জানুয়ারি।
রাজধানীর পশ্চিম রামপুরায় উলনবাজারের কাছে তানজিলাদের বাসা। দেয়ালঘেরা জায়গায় উঠান ঘিরে কয়েকটি ঘর। তেমনই একটি ঘরে মাসে ৫ হাজার টাকা ভাড়ায় তানজিলা থাকেন মা রোকেয়া বেগম (৫৫) ও একমাত্র ভাই মাসুদ রানার (২৩) সঙ্গে। তানজিলা চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। তিন বছর আগে বাবা মনির হোসেন অন্যত্র বসবাস শুরু করলে ভাইয়ের ওপর সংসারের চাপ বাড়ে। ভাই রাইড শেয়ারিং পাঠাওয়ের গাড়ি চালান।
তানজিলার অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটে ১০ বছর আগে ২০১৪ সালের ৭ নভেম্বর। শিক্ষকের বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে তাঁর মুখমণ্ডলসহ পুরো দেহ পুড়ে যায়। তিন মাস তাঁর চিকিৎসা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। ওই সময় ডান পায়ে সংক্রমণ হলে পা ঊরু থেকে কেটে বাদ দেন চিকিৎসকেরা। তানজিলার সঙ্গে দগ্ধ হয়ে মারা যায় তাঁর বড় বোন রুমা আক্তারের মেয়ে আশরাফী (৭)।
‘একদিন আমার সফলতার গল্প লিখবেন আপনারা’
গত বছরের ২১ অক্টোবর তানজিলাকে নিয়ে প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে ‘শরীর পুড়েছে, পা হারিয়েছেন—স্বপ্নপূরণে হার মানেননি তানজিলা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই সময় স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স (শি) তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে সহায়তা দেয় এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দানশীল নারী তানজিলা কী নিয়ে কাজ করতে চান, তা জানতে চেয়ে অর্থ সহায়তা দেন। নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী তানজিলা ওই টাকা দিয়ে কিছুদিন আগে পোশাক বিক্রির উদ্যোগ শুরু করেন। নিজের উদ্যোগের নাম দিয়েছেন ‘অপরাজিতা’। ফেসবুকে পেজ খুলেছেন ।
এখন পর্যন্ত পেজে সাড়া পাওয়ার হার সামান্য। নিজের ঘর আর রাস্তাই পোশাক বিক্রির জায়গা। দুটি ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে বললেন, ‘যা এনেছি, তার বেশির ভাগই বিক্রি হয়ে গেছে।’
তানজিলা জানান, গত ১৪ ডিসেম্বর প্রথম তিনি ব্যবসা শুরুর জন্য কেনাকাটা করেন। তালিকায় ছিল ১০টি শাড়ি, ৩টি লুঙ্গি, ২০টি থ্রি-পিস এবং মেয়েদের অন্তর্বাস। ১৬ ডিসেম্বর পাড়ার দোকানের সামনে টুলে মাকে কাপড়চোপড় দিয়ে বসিয়ে আসেন। সবাই কৌতূহল নিয়ে তাকালে মা বলেন, ‘শিলা ব্যবসা দিছে।’ একজন দুটো থ্রি-পিস কিনে নেন। সেদিনই তাঁর বিক্রি হয়েছিল ২ হাজার ৬০০ টাকার পণ্য।
‘তানজিলা আত্মবিশ্বাসী মেয়ে। অনেক প্রতিকূলতাও তাঁকে ভেঙে ফেলতে পারেনি। এই আত্মবিশ্বাসই তাঁকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে। প্রথম আলো শিক্ষাবৃত্তি দেওয়ায় ওর শিক্ষাজীবন নিশ্চিত হলো। এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। তানজিলার মতো আমি নিজেও এতে সম্মানিত বোধ করছি। তানজিলা যেন নিয়মিত পড়াশোনা করতে পারে, নিজের জীবিকার পথটুকু প্রশস্ত করতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখবে শি।’
তানজিলা জানান, আগের দিন মা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এসেছিলেন, ‘শিলা ব্যবসা দিছে। তোমরা একটু কিন্যো।’ এখনো বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলেন। এখন অনলাইনে বিক্রির দিকে মনোযোগ দিতে চান। কোনো এক দিন দোকান দিতে পারবেন, সে প্রত্যাশা তাঁর।
তানজিলার ভাষায়, তিনি তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যের প্রতি মানুষের ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারছেন। এ কারণে তাঁর মনে হয় তিনি পারবেন। সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পান বন্ধু রাফার কাছ থেকে। জোরে হেসে বললেন, ‘প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশের পর কলেজে আমি তো “ভাইরাল”। ওই যে হাসি দেওয়া ছবিটা ছেপেছিলেন না, ওটা দেখায় সবাই।’ পাড়ার লোকজনও তাঁকে বলে, ‘দেখবি, তুই একদিন অনেক ওপরে উঠবি।’
তানজিলা বলেন, ‘১০ বছর আগে হাসপাতালে আমাকে দেখেছিলেন সাংবাদিকেরা। তখন আমি মরি কি বাঁচি, তা নিয়েই ছিল সংশয়। এরপর আবার সাংবাদিকদের দেখলাম খেলার মাঠে। ওই সময় তাঁরা আমার স্বপ্নের কথা জেনেছেন। আশা করি, এরপর যখন সাংবাদিকেরা আমাকে দেখবেন, তখন আমি পড়ালেখা শেষ করা সফল উদ্যোক্তা হিসেবেই পরিচয় দিতে পারব। একদিন আমার সফলতার গল্প লিখবেন আপনারা (সাংবাদিকেরা)’ (একগাল হেসে)।
তানজিলা জানান, তাঁকে অনেকেই প্রতিবন্ধী বলে, অসুস্থ হিসেবে দেখে। কিন্তু তিনি নিজেকে অসুস্থ মনে করেন না।
তানজিলা বলেন, ‘আমার মন সুন্দর। তাই আমি সুস্থ। আমি একা চলতে পারি। আমি ক্রাচে ভর দিয়ে বাসে করে প্রতিদিন কলেজে গেছি। এখন ব্যবসার জন্য পণ্য কিনতে যাই। আমাকে প্রতিবন্ধী বলা যায়, বলেন! আমি তো সব পারি।’
যখন প্রচণ্ড হতাশায় ডুবে যান, তখনো নিজেকে নিজেই বুঝিয়ে-শুনিয়ে মানসিক শক্তি জোগান বলে জানান তানজিলা।
‘এই শিক্ষাবৃত্তির মর্যাদা যেন রাখতে পারি’
প্রথম আলো ট্রাস্ট তানজিলাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার জন্য চার বছরের শিক্ষাবৃত্তি দিয়েছে। এই বৃত্তির আওতায় এই বছর থেকে শিক্ষাব্যয় হিসেবে প্রতি মাসে চার হাজার করে টাকা পাবেন তিনি।
স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্সের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শারমিন ফারহানা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তানজিলা আত্মবিশ্বাসী মেয়ে। অনেক প্রতিকূলতাও তাঁকে ভেঙে ফেলতে পারেনি। এই আত্মবিশ্বাসই তাঁকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে। প্রথম আলো শিক্ষাবৃত্তি দেওয়ায় ওর শিক্ষাজীবন নিশ্চিত হলো। এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। তানজিলার মতো আমি নিজেও এতে সম্মানিত বোধ করছি। তানজিলা যেন নিয়মিত পড়াশোনা করতে পারে, নিজের জীবিকার পথটুকু প্রশস্ত করতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখবে শি।’
মা রোকেয়া বেগম বললেন, ‘আপনারা আমার মেয়েটার জন্য অনেক করলেন। আপনাদের জন্য আমার অনেক দোয়া থাকল। মেয়েটা যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, সেই দোয়া করবেন।’
প্রথম আলোর শিক্ষাবৃত্তি পাওয়ার খবর শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তানজিলা। কয়েক মুহূর্ত কোনো কথাই বলতে পারেননি। ধরা গলায় বললেন, ‘কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। প্রথম আলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর কোনো ভাষা নেই। শুধু মনে হচ্ছে, যদি আপনারা আমাকে আগে খুঁজে পেতেন, তাহলে লেখাপড়া নিয়ে এত কষ্ট করতে হতো না। আমি যেন এই শিক্ষাবৃত্তির মর্যাদা রাখতে পারি। শি-সহ যাঁরা আমাকে জীবিকার জন্য সহায়তা করেছেন, তাঁদের মুখ যেন উজ্জ্বল করতে পারি।’