আট হাজার কোটি টাকা খরচ, তবু মুক্তি পায়নি চট্টগ্রামবাসী

প্রকল্পগুলোর শেষ মুহূর্তে এসে ২৬ সমস্যা চিহ্নিত। সমাধানে বিশেষ উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকারের।

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনঃখনন ও সংস্কারকাজ চলছে। গতকাল নগরের বহদ্দারহাটেছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চার প্রকল্পের কাজ চলছে ৫ থেকে ১১ বছর ধরে। দুটি প্রকল্পের মেয়াদ গত বছরের জুনে শেষ হলেও কাজ চলমান। বাকি দুটির মধ্যে একটির মেয়াদ আছে ছয় মাস, অন্যটির দেড় বছর। প্রায় শেষ মুহূর্তে এসে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ২৬টি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি, চ্যালেঞ্জ ও তা মোকাবিলায় সুপারিশের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়। ৯ জানুয়ারি এই প্রতিবেদন সরকারের উচ্চপর্যায়ে জমা দিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার মো. জিয়াউদ্দীন। প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং উপদেষ্টার একান্ত সচিবের কাছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে চার প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। এত টাকা খরচের পরও নগরবাসী এর সুফল পায়নি। জলাবদ্ধতা সমস্যা রয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় নগর।

এখন প্রকল্পগুলোর জন্য চাহিদা অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে না। আবার খাল ও খালের পাড়ে নির্মিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আইনি জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। এর ফলে আটকে যাচ্ছে নির্মাণকাজ ও ভূমি অধিগ্রহণ। এ ধরনের বাধা বা সমস্যা আগেও চিহ্নিত করা হয়েছিল। তবে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা সমস্যা নিয়ে এবার বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে থেকে তৎপর হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশনায় ৫ জানুয়ারি জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে করণীয় নির্ধারণ নিয়ে সভা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন তিন উপদেষ্টা—মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও ফারুক-ই-আজম। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত এ সভায় জলাবদ্ধতা নিরসন কাজের জন্য নয়টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কোন সংস্থার কী দায়িত্ব, তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২ জানুয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী তিন সংস্থাকে নিয়ে সভা করেছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার।

আগামীকাল রোববার বিকেলে জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করবেন চার উপদেষ্টা। তাঁরা হলেন মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আদিলুর রহমান খান ও ফারুক-ই-আজম। আজ তাঁরা প্রকল্প এলাকার কাজ পরিদর্শন করবেন।

সরকারের এমন তৎপরতায় জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে চার উপদেষ্টাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তাঁরা চট্টগ্রামে এসে বিশেষ বৈঠক করবেন। আর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রকল্পে ৩৬টি খাল ছিল। এর বাইরে থাকা ২১টি খালও যুক্ত করা হবে। তাই জলাবদ্ধতার সমস্যা ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ সমাধান হবে।  

জলাবদ্ধতা দূর করতে সিডিএ দুটি, সিটি করপোরেশন একটি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তিন সংস্থা কাজ করলেও প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের কারণে ১০ থেকে ১৩ বার পর্যন্ত ডুবে যায় নগর।

শেষ পর্যায়ে কাজ করতে যত সমস্যা

বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলোর নির্মাণকাজ ও ভূমি অধিগ্রহণের জন্য চাহিদা রয়েছে ৬৬২ কোটি টাকা। কিন্তু এই বরাদ্দ পাচ্ছে না সংস্থাগুলো।

চারটি প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৬টি সমস্যা রয়েছে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকার ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পে। এখন প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়াসহ এ প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলো হচ্ছে পাহাড় কাটা ও বন উজাড়ের কারণে খাল-নালা ভরাট হয়ে যাওয়া। খাল ও নালা পরিষ্কার করলেও মানুষের সচেতনতার অভাবে ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাওয়া। খালের পাড় এবং খালের জায়গায় নির্মিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে জটিলতা, খালের পাশে রাস্তা না থাকায় নির্মাণকাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। 

সিডিএর নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড (ইসিবি)। ইতিমধ্যে প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৭৫ শতাংশ। টাকা খরচ হয়েছে ৪ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। আগামী বছরের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে।

১১ বছর আগে অনুমোদন পাওয়া ১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকায় বাস্তবায়নাধীন বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খনন প্রকল্পের মেয়াদ গত বছরের জুনে শেষ হয়েছে। আর মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। মেয়াদ না বাড়ানোসহ তিনটি বাধার কথা উল্লেখ করেছে সিটি করপোরেশন। অন্য দুটি হচ্ছে ভূমি অধিগ্রহণে মামলা জটিলতা এবং খাল রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ব্যবহারের জন্য আড়াই একর জমি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক অনুমোদনে জটিলতা।

কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের চারটি বাধার মধ্যে প্রধান হচ্ছে প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় না হওয়া। জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ জটিলতা এবং ভূমি কেনার জন্য পর্যাপ্ত টাকা না পাওয়া। ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যানিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা/জলাবদ্ধতা নিরসন, নিষ্কাশন ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না পাওয়া বড় সমস্যা। অন্য দুটি সমস্যা হচ্ছে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন না হওয়া এবং ৩২০ কোটি টাকার তহবিল না পাওয়া। ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পের মেয়াদ গত বছরের জুনে শেষ হয়ে গেলেও এখনো সময় বাড়ানো হয়নি।

কোন কাজ কে করবে

৫ জানুয়ারি ঢাকায় তিন উপদেষ্টার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হওয়া সভায় জলাবদ্ধতা নিরসনে কোন সংস্থার কী করণীয় তা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে সব ধরনের পাহাড় কাটা বন্ধে জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও পরিবেশ অধিদপ্তর, খাল ও নালা-নর্দমা পরিষ্কারের কাজ সিটি করপোরেশন, জোয়ার প্রতিরোধক ফটকগুলো কার্যকরে সিডিএ, পাউবো, সেনাবাহিনীর ৩৪ ইসিবি কাজ করবে। প্রতি মাসে একটি করে সমন্বয় সভা করবে বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়। কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা ও গভীরতা বজায় রাখতে ড্রেজিং বা খননকাজ করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলো ছিল ত্রুটিপূর্ণ ও অপরিপূর্ণ। এর আগে সমস্যা চিহ্নিত করা হলেও তা সমাধানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখন যেসব সমস্যা শনাক্ত করা হয়েছে, তা সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ এবং ভূমি অধিগ্রহণের মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে দ্রুত। না হলে জলাবদ্ধতার সমস্যার তেমন সমাধান হবে না।