বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয়ী শক্তির কেউ কেউ বৈষম্য টিকিয়ে রাখার পক্ষে। তাঁদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল চেতনা ধারণ করার কোনো ইঙ্গিত দেখতে পাওয়া যায় না। তাঁরা এমন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন, যার প্রবৃত্তি-প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক।
গতকাল সোমবার ‘সুশাসনের জন্য জনসম্পৃক্ত সংস্কার: অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী এক নাগরিক সম্মেলনে এ কথা বলেন আলোচকেরা। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এ সম্মেলনের আয়োজন করে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম। গতকাল ছিল সম্মেলনের সমাপনী দিন।
সম্মেলনে আলোচকদের কথায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনে অমুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব না থাকার বিষয়টি উঠে আসে। আলোচকেরা বলেন, গণ–অভ্যুত্থানের পর ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা আরও বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠেছেন। সংখ্যালঘু, অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠী ও লিঙ্গবৈচিত্র্যের মানুষদের জন্য আলাদা একটি সংস্কার কমিশন গঠনের প্রয়োজন থাকলেও তা করা হয়নি। অধিকার রক্ষায় নতুন কমিশন গঠনের প্রস্তাবও এসেছে সম্মেলন থেকে।
সম্মেলনের সমাপনী দিনের সভাপতি ছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান। ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে করা হলেও অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কমিশনগুলো কাজ করছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ জন্য নতুন করে কমিশন করলে সেগুলোকে কীভাবে কার্যকর করা যাবে, সে প্রশ্ন তোলেন রওনক জাহান। তিনি বলেন, এ ব্যর্থতার জন্য রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হচ্ছে। তবে আমলাতন্ত্র, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী ছাড়া চলবে না। তাঁরা যাতে কাজ করেন, সে জন্য সারাক্ষণ তাঁদের নজরে রাখার দায়িত্ব নাগরিকদের।
দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হওয়ার পর লজ্জায় পাকিস্তান আমলে একজন সচিব আত্মহত্যা করেছিলেন উল্লেখ করে রওনক জাহান বলেন, তখন একটা লজ্জাবোধ ছিল। তার মানে একটা অগ্রহণযোগ্যতা ছিল। এখন সেই অবস্থায় পরিবর্তন এসেছে।
সংখ্যালঘু, অসুবিধাগ্রস্ত ও বৈচিত্র্যতা সংস্কার কমিশন এবং শিক্ষা সংস্কার কমিশন হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
লিঙ্গবৈচিত্র্যের ঝুঁকি আগে ছিল এবং এখন এর ব্যাপকতা ও গভীরতা অনেক বেড়েছে বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘সেটা বাড়ছে এ কারণে যে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যাঁরা নিজেদের বিজয়ী ভাবছেন, মনে করছেন ক্ষমতায় এসে গেছেন, তাঁদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল চেতনা ধারণ করার কোনো ইঙ্গিত আমরা দেখতে পাই না। বরং তাঁরা এমন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন, যার মূল কনসেপচুয়ালাইজেশন (ধারণা), ইনড্রকটিনেশন (প্রবৃত্তি) ও প্রসেস (প্রক্রিয়া) সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক। এসব বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।’ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল চেতনা থেকে বিচ্যুত সব অপশক্তিকে কেন পরাজিত করার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে না, সরকারের কাছে সে দাবি তুলতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যাঁরা নিজেদের বিজয়ী ভাবছেন, মনে করছেন ক্ষমতায় এসে গেছেন, তাঁদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল চেতনা ধারণ করার কোনো ইঙ্গিত আমরা দেখতে পাই না।
সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ভূমিকার সমালোচনা করেন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। এ অনুষ্ঠানে আসার আগে গতকাল সরকারের জ্যেষ্ঠ সচিব, সচিবসহ সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বলে জানান তিনি। ওই বৈঠকে কীভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যায়, সে প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সেখানে গত নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠেছে উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘তাঁদের মনোভাব—কেষ্ট বেটাই চোর। তাঁরা বলেছেন, “ওপর থেকেই সব সিদ্ধান্ত হয়েছে, পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছে, আমাদের কী করার আছে?” তার মানে তাদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই।’ এ কথা যদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বলেন, তাহলে কী হবে, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের চেয়ে আমলারা বেশি শক্তিশালী বলে উল্লেখ করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আজকে যারা আমলা, কাল সে রাজনীতিবিদ, পরের দিন সে ব্যবসায়ী। এটিই সমস্যা হয়ে গেছে যে তাঁরা বহু রূপে আমাদের সামনে আসছেন।’
বৈষম্যবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে মানুষ ফেলে দিয়েছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা লক্ষ করছি, বৈষম্যবিরোধী চেতনার পক্ষের শক্তির ভেতরে কেউ না কেউ বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে যুক্তিতর্ক দিচ্ছে। এভাবে বৈষম্যবিরোধী চেতনার মূল তাৎপর্য তারা ক্ষুণ্ন করছে।’
সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক নুরুল হুদা, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (এআইইউবি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফারিয়া সুলতানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ এম শাহান ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ডেপুটি রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ সোনালি দয়ারত্ন।