৫ বছরে সড়কে নিহত ৫,৯১৬ শিক্ষার্থী, অর্ধেকই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়

এ সময়ে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩৪ হাজার ৪৭৮ জন নিহত। এর মধ্যে ১৬ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী।

চুয়াডাঙ্গা শহরের বুজরুকগড়গড়ি এলাকার কলেজছাত্র রাজ হোসেন (১৭) গত ১৬ জুন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। রাজের বাবা অটোরিকশাচালক। তাঁর কাছে ছেলের আবদার ছিল একটা মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার। কিন্তু এ বয়সে মোটরসাইকেল চালানোর ঝুঁকি এবং নিজেদের আর্থিক অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বাবা ছেলেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা ছেলের বারবার অনুরোধে মোটরসাইকেল কিনতে বাধ্য হন তিনি।

মোটরসাইকেল কেনার দিন কয়েকের মধ্যে রাজ ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসে। তারপর কয়েক দিন মোটরসাইকেল চালানো বন্ধ ছিল। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই আবার সড়কে বন্ধুদের নিয়ে জোর গতিতে মোটরসাইকেল চালানো শুরু করে রাজ। ১৬ জুন চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা সড়কে দ্রুতগতির একটি বাস তাকে চাপা দিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় কলেজগামী ছেলেটির।

সড়কে এভাবেই প্রতিদিন প্রাণ যাচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীর। গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান রোড সেফটি ফাউন্ডেশন তাদের সাম্প্রতিক গবেষণায় বলেছে, গত সাড়ে পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৫ হাজার ৯১৬ শিক্ষার্থীর। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই মারা গেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। আর আঞ্চলিক সড়কগুলোতেই দুর্ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি।

আজ শনিবার গবেষণা প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন ও নিজস্ব অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করেই রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গবেষণাটি করেছে।

এতে দেখা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে শুরু করে এ বছরের জুন মাস পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩৪ হাজার ৪৭৮ জন নিহত হন। এর মধ্যে ১৬ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী।

প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে ২ হাজার ৬৪১ জন । আর ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৯৭৮ জন।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বেশি প্রাণহানি

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গবেষণা অনুযায়ী, মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী হিসেবে নিহত হয়েছে ২ হাজার ৭৮৩ শিক্ষার্থী। দুর্ঘটনায় নিহত মোট শিক্ষার্থীর এটি প্রায় অর্ধেক।

আর শিক্ষার্থীরা পথচারী হিসেবে যানবাহনের চাপা বা ধাক্কায় নিহত হয়েছে ১ হাজার ৫৩৪ জন। যানবাহনের যাত্রী হিসেবে নিহত হয়েছে ৭২১ জন। আবার বাইসাইকেল আরোহী হিসেবে নিহত হয়েছে ৪৯৭ জন। অটোরিকশার চাকায় ওড়না বা পোশাক পেঁচিয়ে মৃত্যু হয়েছে ৮৪ জনের।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, অনিরাপদ ও বিশৃঙ্খল সড়কে যখন মানুষের যাতায়াত বেড়ে যায়, তখন দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। বাংলাদেশেও তা–ই হচ্ছে। দেখা গেছে, স্কুল, কলেজগামী শিক্ষার্থীদের এই সড়কে যাতায়াত বেশি। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে মোটরসাইকেলে করে স্কুলে আনা–নেওয়ার সংখ্যাটা অনেক বেড়ে গেছে। একে অনিরাপদ সড়ক, তার ওপর যথাযথ যানবাহন নেই। তাই মোটরসাইকেলের ওপর ভরসা করে থাকা মানুষের প্রাণ যাচ্ছে বেশি।

দুর্ঘটনা পর্যালোচনা

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গবেষণা অনুযায়ী, ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী শিক্ষার্থী স্কুলে যাওয়া-আসার পথে, বাড়ির আশপাশে খেলার সময় অটোরিকশার ধাক্কায়, বাইকের ধাক্কায়, পণ্যবাহী যানবাহনের ধাক্কায় বা চাপায় নিহত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা গ্রামীণ সড়কে বেশি ঘটেছে।

আর ১৩ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা বাইকের চালক ও আরোহী হিসেবে বেশি নিহত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা আঞ্চলিক ও মহাসড়কে বেশি ঘটেছে।

বাইসাইকেল আরোহীরা থ্রি-হুইলার, মোটরসাইকেল এবং অনিরাপদ মালবাহী যানবাহনের ধাক্কায় গ্রামীণ ও আঞ্চলিক সড়কে বেশি নিহত হয়েছে।

মো. হাদিউজ্জামান বলেন, আঞ্চলিক সড়কগুলোকে কোনোরূপ নিয়মনীতি না মেনে দ্রুতগতির করা হচ্ছে। বাড়িঘরের পাশ দিয়ে চলছে সড়ক। কিন্তু বাড়িঘর থেকে ন্যূনতম দূরত্ব বজায় রাখার যে নিয়ম, তা মানা হচ্ছে না। আবার সড়কের সমান্তরাল হচ্ছে বাড়িঘরগুলো। এটিও নিয়মের ব্যত্যয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে আঞ্চলিক সড়কে, ২৯ শতাংশ। এরপর যথাক্রমে আছে শহরের সড়ক, গ্রামীণ সড়ক ও মহাসড়ক।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কোনো টেকসই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, তা অনেকটা অবৈজ্ঞানিক ও সমন্বয়হীন। দেশের নৈরাজ্যকর সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হলে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত টেকসই পরিবহনকৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে।

গবেষণায় সড়কে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আছে ত্রুটিপূর্ণ সড়ক এবং অনিরাপদ যানবাহন, নিরাপদে সড়ক ব্যবহার বিষয়ে জ্ঞানের অভাব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা।‌

সড়কে এভাবে শিক্ষার্থীর মৃত্যু শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়, দেশের অর্থনীতির জন্য এক বড় ধরনের বিপর্যয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, গড়ে এসব শিক্ষার্থীর ৪০ বছরের কর্মজীবন পড়ে ছিল সামনে। ফলে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে পরিবার ও রাষ্ট্রের। পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থী আহত হচ্ছে। এর বোঝা পরিবার ও রাষ্ট্র—উভয়কেই বহন করতে হচ্ছে।

[তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন প্রথম আলোর চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি]