স্বাস্থ্যের সংস্কার নির্ভর করছে তরুণদের ওপর

স্টেথোস্কোপপ্রতীকী ছবি

স্বাস্থ্য খাতের নানা বিষয় সংস্কারে বিভিন্ন সময় ৫০ থেকে ৬০টি দলিল বা সুপারিশমালা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষা করে, এমন বিষয়গুলো শুধু বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য খাতে পরিবর্তন নির্ভর করছে তরুণ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের ওপর।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্মাণকল্পে এজেন্ডাভিত্তিক অংশীজন সভা’য় জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য খাত সংস্কারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্যরা এই কথা বলেন। চিকিৎসক ও চিকিৎসা শিক্ষার্থী ফোরাম, বাংলাদেশ এই সভায় আয়োজন করে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যবিদ ছাড়াও অনুষ্ঠানে তরুণ চিকিৎসকেরা অংশগ্রহণ করেন।

হেলথ সার্ভিস কমিশন গঠন জরুরি

অনুষ্ঠানে চিকিৎসকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নানা ধরনের ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা হয়। জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদ–ই–মাহবুব বলেন, চিকিৎসকদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রির ব্যাপারে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি আছে। এই সমন্বয়হীনতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চিকিৎসকেরা। তিনি আরও বলেন, দলবাজিও চিকিৎসকদের অনেক ক্ষতির কারণ।

আমলাতন্ত্র নানাভাবে স্বাস্থ্য খাত ও চিকিৎসকদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, বর্তমান কাঠামোয় চিকিৎসকেরা আমলাদের হাতে ঔপনিবেশিকভাবে পরাধীন। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো পৃথক বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস কমিশন গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ে দুটি বিভাগ হওয়ার কারণে মাঠপর্যায়ের কাজে দ্বৈধতা আছে, সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ে। এতে সম্পদের অপচয় হচ্ছে।

প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠানের শুরুতে চিকিৎসক জাহির হোসেন তরুণ চিকিৎসকদের পক্ষে কথা বলেন। তিনি চিকিৎসা সুরক্ষা আইন পাস, হাসপাতালে পুলিশি ব্যবস্থা চালু এবং মানহীন মেডিকেল কলেজ বন্ধ করার দাবি জানান। তিনি আরও বলেন, মেডিকেল কলেজে অপরাজনীতি বন্ধ করতে হবে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ইমরান বিন ইউসুফ চিকিৎসকদের নীতিনৈতিকতা দৃঢ় করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যত জ্যেষ্ঠ (সিনিয়র) হই, তত দাস হয়ে যাই।’ প্রবীণ এই চিকিৎসক বলেন, অনেক চিকিৎসকের নামের পাশে ভৌতিক ডিগ্রি ব্যবহার করতে দেখা যায়। চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ড বয়—তাঁদের নিয়ে দলগতভাবে চিকিৎসা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। এখন সেই দলটি ভেঙে গেছে। তাই চিকিৎসকেরা মার খেলেও অন্যরা এগিয়ে আসেন না।

প্রসঙ্গ ভারতীয় চিকিৎসক

অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে ভারতীয় চিকিৎসকদের এ দেশে পেশা চর্চার সমালোচনা করা হয়। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক আরিফ মোর্শেদ খান বলেন, বিশেষ অনুমতি ছাড়া অন্য দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা ভারতের কোনো হাসপাতালে এমনকি প্রশিক্ষণের সময়ও রোগীর শরীরে হাত দিতে পারেন না, কিন্তু বাংলাদেশে হামেশা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ইনফার্টিলিটি কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের চিফ কনসালট্যান্ট অধ্যাপক রাশিদা বেগম বলেন, নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন ভারতের চিকিৎসকেরা শুধু চিকিৎসাই করেন না, রোগীও ভারতে পাঠানোর পরামর্শ দেন। তবে একাধিক অংশগ্রহণকারী বলেন, বাংলাদেশের রোগী কেন ভারতে যাচ্ছে, ভারত ও বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা রোগীকে কতটা সময় দেন—এ বিষয়গুলো ভেবে দেখা দরকার।

অ্যাসোসিয়েশন অব ফিজিশিয়ানস বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক সৈয়দ আতিকুল হক বলেন, সংস্কার করতে হলে অভীষ্ট বা রূপকল্প থাকতে হবে। দুর্বলতা, সামর্থ্য বিশ্লেষণ করে পরিকল্পনা করা জরুরি। তিনি বলেন, মেডিকেল পাঠ্যসূচির আধুনিকায়ন হয়নি। নৈতিকতা, মানবিকতা, যোগাযোগ দক্ষতার মতো বিষয়গুলো পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা না হলে এখন মধ্যবিত্তরা চিকিৎসার জন্য ভারত যাচ্ছেন, ভবিষ্যতে নিম্নবিত্তরাও যাবেন।

রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় দেশের অন্যতম বৃহৎ দুটি হাসপাতাল। একটি বিএসএমএমইউ ও অন্যটি বারডেম। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য এসব হাসপাতালে রোগীদের সমস্যা হয়। এ বিষয়ে বিএসএমএমইউর উপাচার্য মো. সায়েদুর রহমানের বক্তব্য জানতে চান অনুষ্ঠানের আয়োজকেরা। সায়েদুর রহমান বলেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। আবার বিষয়টিতে দৃষ্টি দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। শাহবাগের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে দেশের অনেকগুলো সেরা ও বড় চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন এসব হাসপাতালে এক লাখের মতো মানুষ আসে। এই বিষয়টি নিয়ে ক্রিয়াশীল পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক উপাচার্য লিয়াকত আলী বলেন, এই সরকার আইন করতে না পারলেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করতে পারে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনে কী আছে, তা অনেকেই জানেন না। এর খসড়া সবার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।

ক্যানসার বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পরও কীভাবে বছরের পর বছর বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, তার বর্ণনা দেন তরুণ চিকিৎসক হাসান শাহরিয়ার। তিনি বলেন, ঠিক মানুষকে ঠিক জায়গায় দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বিসিপিএসের সাবেক সচিব অধ্যাপক

আবদুল জলিল চৌধুরী, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের সাবেক প্রধান নির্বাহী এম এ রশিদ ও পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন আফতাব উদ্দিন।