সদ্য বিয়ে করে পল কনেট ও এলেন কনেট দম্পতি তখন হানিমুনে। মার্চের শেষের দিকে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া গণহত্যা নাড়া দেয় তাঁদের। তখনই সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের সবটুকু নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়াবেন।
হানিমুন অসমাপ্ত রেখে মার্চে এ দম্পতি ফিরে আসেন লন্ডনে। সেখানে থাকা প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে আয়োজন করেন ২৫ হাজার মানুষের বিশাল সমাবেশ। শরণার্থীদের জন্য সহায়তা তহবিল সংগ্রহ করতে গড়ে তোলেন ‘অপারেশন ওমেগা’। এমনকি একটি মেডিকেল ভ্যানে প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে তাঁরা ইউরোপ থেকে সড়কপথে চলে আসেন বাংলাদেশে। এর মধ্যে পলের স্ত্রী এলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়ে এলেনকে যশোরের এক কারাগারে পাঠায় তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক সরকার। ২০১৩ সালে সে কারাগার পরিদর্শন করেছিলেন এ ব্রিটিশ দম্পতি।
তাঁদের অনন্য সে কীর্তি ও অবদানের নানা অজানা গল্প নিয়ে রাজধানীর গুলশানের লেক পার্কে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী এক প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে এই ব্রিটিশ দম্পতির বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকার নানা চিত্র ও অন্যান্য প্রামাণিক দলিল স্থান পেয়েছে। আজ বুধবার সকালে যুক্তরাজ্যের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার জেমস গোল্ডম্যান ও জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোস্টার এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। গুলশান সোসাইটি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজনে ‘হিউম্যানিটি ইজ ওয়ান’ শিরোনামে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে ২৮ মার্চ (শুক্রবার) পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ৯টায় প্রদর্শনী শুরু হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে।
যুক্তরাজ্যের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার জেমস গোল্ডম্যান বলেন, ‘আমার কাছে পল ও এলেনের যাত্রাটা অনুপ্রেরণাদায়ক। আমি তাঁদের এ অসাধারণ গল্পটা জানতাম না। আজকে জেনেছি। তাঁদের এ গল্প বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার যে ঐতিহ্য, সেটার একটি শক্তিশালী নিদর্শন।’
মহাদেশ পাড়ি দিয়ে মেডিকেল ভ্যানে বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে আসার যাত্রাটা অতুলনীয় বলে উল্লেখ করেন জেমস গোল্ডম্যান। তিনি বলেন, ‘বেশি দিন হয়নি আমি বাংলাদেশে এসেছি। যার সঙ্গেই কথা বলেছি, প্রত্যেকের গল্প কোনো না কোনোভাবে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁরা পড়াশোনা করেছেন সেখানে, এখন তাঁদের সন্তানেরা পড়ছেন, পরিবারের সদস্যরা থাকেন যুক্তরাজ্যে। গল্পগুলো একই সূত্রে গাঁথা। এ সম্পর্ক ঐতিহাসিক।’
১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে দুই দেশের যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে, সেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও দৃঢ় হয়েছে বলে মন্তব্য করেন জেমস গোল্ডম্যান।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি গুরুত্ব দিয়ে জার্মান সংবাদমাধ্যমে ছাপা হতো বলে উল্লেখ করেন ঢাকায় জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোস্টার। তিনি বলেন, ‘আমার মনে পড়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনতাম তখন আমরা। স্বাধীনতার পর যে দুর্ভিক্ষ, সেটাও জার্মান সংবাদমাধ্যমে ভালোভাবে এসেছে। এভাবে বাংলাদেশ একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছিল আমাদের কাছে।’
জার্মান রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘যদিও আমার দেশ তখন ডিভাইডেড (দুই ভাগে বিভক্ত) ছিল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করেছিল জার্মানি। তখন থেকে বাংলাদেশ আমাদের নির্ভরযোগ্য সহযোগী। জার্মানি বাংলাদেশের পাশে থাকবে শুধু উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে নয়, গণতান্ত্রিক রূপান্তরেও।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, ১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সময় তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণিক দলিল খোঁজা শুরু করেন। তখন পল কনেট ও এলেন কনেটকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কেউ তাঁদের সন্ধান দিতে পারছিলেন না। ১৯৭১ সালের পর তাঁরা কোথায় থাকছেন, সে বিষয়ে কারও কোনো ধারণা ছিল না। তারপর ২০১১ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হারুনুর রশিদ কানাডায় এক ট্রেনে পলের সন্ধান পান। দেশে ফিরে তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসে জানান যে ট্রেনে একজনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে, যাঁর কাছে যুদ্ধের অনেক গল্প জমা আছে।
মফিদুল হক হারুনুর রশিদের কাছ থেকে তাঁর নাম জানলেন পল কনেট। এরপর পলের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানানোর সিদ্ধান্ত নিলে পল ও এলেনকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হয় জানিয়ে মফিদুল হক বলেন, ‘সম্মাননা দেওয়া হলে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যশোরে যাই আমরা। ত্রাণের নৌকা নিয়ে যশোর হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছিলেন এলেন কনেট। যশোরের একটি চার্চে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রাজাকাররা তাঁর অবস্থান পাকিস্তানি আর্মির কাছে বলে দিলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে দুই বছরের সাজা দিয়ে যশোর জেলে প্রেরণ করা হয় এলেনকে।’
আয়োজকেরা জানান, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ দেশে ফিরে যান পল কনেট ও এলেন কনেট। বর্তমানে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। এই দম্পতি দীর্ঘদিন পরিবেশ ও পানিদূষণ রোধে কাজ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাংলাদেশি ও তৎকালীন ব্রিটিশ শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্ল্যাটফর্ম ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর সদস্য আবদুল মাজিদ চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন ঢাকায় গণহত্যা ঘটে, সে সময় তিনি শিক্ষার্থী হিসেবে লন্ডনে ছিলেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। ওই সময় আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভায় বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সম্মেলনে অংশ নিতে যান। ২৬ মার্চ তিনি পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের প্রধান হিসেবে সম্মেলনে যোগ দেন। এই সুযোগে আবু সাঈদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার বাইরে কী হচ্ছিল, সেগুলোর বর্ণনা তুলে ধরেন।
ওই দিনই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে লন্ডনে চলে যান বলে জানান আবদুল মাজিদ চৌধুরী। এ ছাড়া ড. মাহবুবুল হক ছিলেন সিঙ্গাপুরে। তিনি ‘নিউক্লিয়ার ফিজিকসের’ শিক্ষক ছিলেন। তিনিও লন্ডনে চলে যান। এরপর তাঁরা লন্ডনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কার্যক্রম শুরু করেন।
বিচারপতি আবু সাঈদ তাঁকে ব্রিটিশ শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দেন উল্লেখ করে মাজিদ চৌধুরী বলেন, এভাবেই অ্যাকশন বাংলাদেশ গড়ে ওঠে।
তাঁদের সে সময়ের নানা কর্মকাণ্ড উল্লেখ করে মাজিদ চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশিরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যা করেছেন, সেটা অতুলনীয়।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সুইডিশ রেডিও এক ঘণ্টা করে বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান প্রচার করত।
গুলশান সোসাইটির আহ্বায়ক শ্রাবন্তি দত্তের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন গুলশান সোসাইটির সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ আহসান হাবিব। অনুষ্ঠানে বক্তব্যের ফাঁকে জোয়ান বায়েজের বাংলাদেশ গানটি পরিবেশন করেন শিল্পী এলিটা করিম।