বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত
ভুল নীতি নেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে
প্রথম আলো ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত: আগামীর ভাবনা’ শিরোনামে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে। সিপিডি পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি ইউনিট এই আয়োজনে সহযোগিতা করে।
গত ১৫ বছরে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪ হাজার মেগাওয়াট থেকে ২৮ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করেছে। কিন্তু উৎপাদিত বিদ্যুৎ আমাদের দেশের ১৭ কোটি মানুষ ব্যবহার করতে পারছে কি? গরমকালে তীব্র লোডশেডিং আমরা অনুভব করি, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এখনো লোডশেডিংয়ের মাত্রা অসহনীয়।
আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় অভিযোগ করে, বিএনপির শাসনকাল ছিল খাম্বা সরকারের শাসনকাল। খুঁটি বসালেও তারা বিদ্যুৎ দিতে পারেনি। আর আওয়ামী লীগ সরকারের সমস্যা হচ্ছে তারা বিদ্যুতের সক্ষমতা অনেক বাড়ালেও সঞ্চালন ও বিতরণ নিশ্চিত করতে পারেনি।
আমরা মনে করি, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সরকার ভুল নীতি অনুসরণ করছে। আমাদের ২৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত আমরা সর্বোচ্চ ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পেরেছি। বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালনের সক্ষমতা তৈরি না করে সরকার রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পথে গেছে।
সংসদে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, গত ১৪ বছরে ৮২টি বেসরকারি ও ৩২টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ সরকার মোট ১ লাখ ৪ হাজার ৯২৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে। আমি হিসাব করে দেখেছি, আমাদের প্রায় ৪ কোটি ৫৬ লাখ গ্রাহক আছে। তাদের বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। প্রত্যেক গ্রাহককে বছরে গড়ে ১ হাজার ৯৭৫ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ বহন করতে হয়। এই একটি কারণেই আমাদের বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল কাঁচামাল হচ্ছে গ্যাস। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা ছিল মুখ্য বিষয়। কিন্তু সরকার সেদিকে যায়নি। গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্স, পেট্রোবাংলাকে শক্তিশালী করা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়নি।
এখন আমাদের সক্ষমতা রয়েছে ২ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করার। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সচল রাখতে হলে ২ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস লাগে। এর জোগান দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ এটি করলে অন্য ক্ষেত্রগুলোতে গ্যাস দেওয়া যাবে না। ফলে জ্বালানির একটা তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। নতুন করে জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম আনা হয়েছে। ইউরেনিয়াম না পেলে কি আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকবে? জ্বালানি নিরাপত্তায় বিদেশনির্ভরতা আমাদের সংকটের মূল কারণ। আমরা ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে যে দামে বিদ্যুৎ কিনি, তা আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচের তুলনায় তিন গুণ।
আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সক্ষমতা রয়েছে, তার ৪০ শতাংশ আমরা উৎপাদন করি। অর্থাৎ সক্ষমতার ৬০ শতাংশ অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের সক্ষমতা ও উৎপাদনের মধ্যে একটা ফারাক থেকে যাচ্ছে। সিপিবির পক্ষ থেকে আমাদের অবস্থান হচ্ছে, পরিবেশবান্ধব ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা। এ জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি বাপেক্সকে শক্তিশালী করতে
হবে। বাপেক্সকে সক্ষম করে তার মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে গ্যাসের মালিকানা দেশেই থাকে।
আমাদের গ্রিডের ২৮ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে ১ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ। সৌরবিদ্যুতের বিষয়টি এক্সপ্লোর করতে হবে। প্রকৃতি আমাদের অঢেলভাবে সূর্যের আলো ও তাপ দিচ্ছে। তাহলে আমরা কেন এটি ব্যবহার করব না? সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে জ্বালানি খাতের সমস্যা কিছুটা দূর করা সম্ভব।
আমরা কমিউনিস্ট পার্টি বরাবরই বলে আসছি, যে ভুল নীতির ওপর দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎ খাতকে পরিচালনা করা হচ্ছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমদানিনির্ভর জ্বালানিকেন্দ্রিক যে বিদ্যুৎকেন্দ্র, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই বেসরকারি কোম্পানিকে বসিয়ে বসিয়ে যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে, তা দেওয়া চলবে না।
(সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ২৬ অক্টোবর ২০২৩)।