মিনিকেট কি মোটা চাল কেটে তৈরি হয়, খেলে কি ক্যানসার হয়, গবেষণা কী বলছে

ফাইল ছবি

এক.

মিনিকেট নামে বাজারে বিক্রি হওয়া চালটি এখন নন্দ ঘোষের ভূমিকায়। সরকার মিনিকেটের ওপর দায় চাপিয়ে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টায় আছে। নতুন সিদ্ধান্ত এসেছে যে মিনিকেট নামে চাল বিক্রি করলে আইনি ব্যবস্থার মুখে পড়তে হবে।

যা-ই হোক, চালের বাজার নিয়ে আলোচনার আগে জেনে আসি, এই নন্দ ঘোষ আসলে কে?

মথুরার রাজা কংস ছিলেন অত্যাচারী ও প্রজাপীড়ক। তাঁর হাত থেকে রক্ষার জন্য কৃষ্ণকে বৃন্দাবনের ঘোষপল্লিতে নন্দ ঘোষের বাড়িতে রেখে আসেন বাসুদেব (কৃষ্ণের পিতা)। অবশ্য কৃষ্ণ ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অসম্ভব দুরন্ত। বৃন্দাবনের বাসিন্দাদের বাড়ি থেকে মাখন-ননি চুরি করে খেয়ে নেওয়াসহ নানা দুষ্টুমি করেই তিনি সময় কাটাতেন।

কৃষ্ণের দুষ্টুমি নিয়ে নালিশ মনোযোগ দিয়েই শুনতেন নন্দ ঘোষ। কিন্তু স্নেহের কৃষ্ণকে কিছুই বলতেন না। একপর্যায়ে সব দোষ হতো তাঁর। সেই থেকে এসেছে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ কথাটি।

আরও পড়ুন

দুই.

ধারণা করা হয়, কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল ৩২২৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। এখন ২০২২ সাল, এ বছরে নন্দ ঘোষদের মধ্যে অন্যতম ‘মিনিকেট’। সরকার এখন মিনিকেটকে বাজার থেকে ‘নাই’ করে দিতে চাইছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম গত বুধবার গাজীপুরে এক অনুষ্ঠানে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এই বলে যে কেউ ‘মিনিকেট’ নামে কোনো চাল বিক্রি করলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেছেন, ‘মিলে চাল বস্তাজাত করার সময় তাতে জাতের নাম লিখে দিতে হবে। কেউ যদি এর ব্যত্যয় করে, সে ক্ষেত্রে আমরা তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থায় যাব।’

ফাইল ছবি

মিনিকেটের ওপর খড়্গহস্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটটাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া সরকার। বাজারে এখন চালের দাম চড়া। এবার বোরোর ভরা মৌসুমে চালের দাম যখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল, তখন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা হুমকি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।

তাতে বিশেষ কোনো কাজ হয়নি। পরে দুই দফায় আমদানিতে করভার কমানো হয়। এতে চালের দাম কিছুটা কমে। যদিও দাম এখনো চড়া।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় মোটা চালের সর্বনিম্ন দর ছিল কেজিতে ৩০ টাকা, এখন তা ৪৮ টাকা। যদিও বাজারে ভালো মানের মোটা চাল কিনতে ৫০ টাকার বেশি লাগছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সরু চালের সর্বনিম্ন দাম ছিল কেজিতে ৪৫ টাকা। এখন তা ৬৪ টাকা।

আরও পড়ুন

তিন.

বাংলাদেশের মানুষের ও কর্তাব্যক্তিদের একটা বদ্ধমূল ধারণা, মোটা চাল কেটে মিনিকেট চাল তৈরি করা হয়। অত্যাধুনিক চালকল আমি দেখেছি। তবে নিজের মতামত দেব না। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) একটি গবেষণা প্রতিবেদনের কথাই বলব।

মন্ত্রীর ব্যাখ্যা বলছে, ঢাকায় বহু মালিকের বাস যেমন বিহঙ্গ, শিকড় ইত্যাদি একক কোম্পানির নামে চলে, তেমনটি মিনিকেট নামে বিভিন্ন জাতের চাল বিক্রি হয়। বাসগুলো লক্কড়ঝক্কড়, তবে চালগুলো সরু। ভাত হয় ঝরঝরে। বাংলাদেশে এই সরু ও ঝরঝরে ভাত মানুষের বিশেষ প্রিয়। পূর্ব এশিয়ার দেশ জাপান, থাইল্যান্ডে ‘স্টিকি রাইস’ বা আঠালো ভাতের জনপ্রিয়তা বেশি।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ মিনিকেট চাল মোটা চাল কেটে তৈরি করা হয় কি না, এর কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে কি না, তা যাচাই করতে ১৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিল।

ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন ওই সময়ে কর্তৃপক্ষের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. ইকবাল রউফ মামুন। কমিটি সরেজমিনে কুষ্টিয়ার অত্যাধুনিক চালকল পরিদর্শন করেছিল এবং দুটি গবেষণাগারে চাল পরীক্ষা করিয়েছিল। পাশাপাশি পলিশ করা চাল নিয়ে বিভিন্ন দেশের গবেষণা পর্যালোচনা করেছিল।

কমিটির গবেষণা প্রতিবেদনের ফলাফল অংশে লেখা হয়েছে—

১. মিলগুলো বিআর-২৮, বিআর-২৯ ও অন্যান্য জাতের ধানকে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ছাঁটাই করে মিনিকেট তৈরি করে—এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

২. মিনিকেট বা পলিশ করা চাল খেলে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে—এর কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ নেই।

৩. পরিমাণে কম হলেও বোরো মৌসুমে মিনিকেট নামেই ধান চাষ হয় (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ধানের জাতের নথি সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে)।

চালের বাজারের সমস্যা আসলে মিনিকেট নয়। সুপারশপে মোট বাজারের তুলনায় নগণ্য কিছু চাল সুদৃশ্য মোড়কে ভরে ‘প্রিমিয়াম প্রাইসে’ বিক্রি করাও দোষের কিছু নয়। ওই চালের ক্রেতা দেশের সচ্ছল মানুষেরা। চালের কেজি ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৭৫ টাকা হলে তাঁদের কিছু যায়–আসে না।

মিনিকেট চালের উৎস কী, তা–ও উল্লেখ করা হয়েছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের গবেষণায়। তাতে জানানো হয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ‘শতাব্দী’ নামক এক জাতের ধানের বীজ একটি প্যাকেটে কিছু সার ও কীটনাশকসহকারে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়, যেটা ‘মিনি কিট’ হিসেবে পরিচিত। সেই ‘কিট’ বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে চলে আসে কোনো না কোনো উপায়ে। চালটি সরু বিধায় সেটা কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তখন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (কুষ্টিয়া) কমিটিকে জানান, এখনো এই ধানের বীজ ভারত থেকে আসে।

অধ্যাপক ইকবাল রউফের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় গত সোমবার রাতে। তিনি বলেন, মিনিকেট মোটা চাল কেটে তৈরি হয়, এটি খাওয়া ক্ষতিকর—এমন প্রমাণ তাঁরা পাননি।

চার.

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার
ফাইল ছবি

মিনিকেট চাল যে মোটা চাল কেটে তৈরি করা হয় না, সেটা জানেন এবং মানেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তাঁর পরিবারে চাল ব্যবসার ঐতিহ্য আছে।

মন্ত্রী গত ডিসেম্বরে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আসলে মিনিকেট ধান নেই। মিনিকেটের নামে জিরাশাইল ও শম্পা কাটারি—এই দুই রকমের ধান থেকে উৎপাদিত চাল বেশি বিক্রি হয়। ব্র্যান্ডটা মিনিকেট।

মন্ত্রীর ব্যাখ্যা বলছে, ঢাকায় বহু মালিকের বাস যেমন বিহঙ্গ, শিকড় ইত্যাদি একক কোম্পানির নামে চলে, তেমনটি মিনিকেট নামে বিভিন্ন জাতের চাল বিক্রি হয়। বাসগুলো লক্কড়ঝক্কড়, তবে চালগুলো সরু। ভাত হয় ঝরঝরে। বাংলাদেশে এই সরু ও ঝরঝরে ভাত মানুষের বিশেষ প্রিয়। পূর্ব এশিয়ার দেশ জাপান, থাইল্যান্ডে ‘স্টিকি রাইস’ বা আঠালো ভাতের জনপ্রিয়তা বেশি।

সরু চাল মূলত ব্যাপকভাবে পলিশ করে মিনিকেট নামে বাজারে ছাড়া হয়। এতে চালের পুষ্টিগুণে ক্ষতি হয়, সেটা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের গবেষণায় এসেছে।

পাঁচ.

চালের বাজারের সমস্যা আসলে মিনিকেট নয়। সুপারশপে মোট বাজারের তুলনায় নগণ্য কিছু চাল সুদৃশ্য মোড়কে ভরে ‘প্রিমিয়াম প্রাইসে’ বিক্রি করাও দোষের কিছু নয়। ওই চালের ক্রেতা দেশের সচ্ছল মানুষেরা। চালের কেজি ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৭৫ টাকা হলে তাঁদের কিছু যায়–আসে না।

সরকারি সংস্থাগুলোর কাজ হলো নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা। সেই বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে দরকার পর্যাপ্ত সরবরাহ। সরবরাহ নিশ্চিতের আগে যা দরকার, তা হলো আমাদের উৎপাদন কতটুকু, সেই তথ্য। অবশ্যই তা নির্ভরযোগ্য হতে হবে।

চালের উৎপাদন কত, সেই হিসাব করার দায়িত্ব বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)। তারা এখন পর্যন্ত গত বোরো মৌসুমে কত চাল উৎপাদিত হয়েছে, সেই হিসাব ওয়েবসাইটে দিতে পারেনি। অন্য মৌসুমের হিসাব যেহেতু দেওয়া হয়েছে, সেহেতু ধরে নেওয়া যায়, বোরোর হিসাবটি এখনো তৈরি হয়নি, তাই ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি।

চালের পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহের কথা বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে মন্ত্রীদের বক্তব্যেই। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০২০ সালের আগস্ট মাসে বলেছিল, দেশে ৫৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। অথচ আমরা দেখেছিলাম, ওই বছরেই চালের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।

ওই যে বাড়ার ধারা শুরু হলো, তা আর কমেনি। এটার কারণ, বাজারে চাল ব্যবসায়ীদের কোনো প্রতিযোগী ছিল না। চালের মতো একটি পণ্য মানুষ কিনবেই। ধরে রাখতে পারলেই বাড়তি দাম পাওয়ার সুযোগ থাকে। এ কারণে চালের বাজারে প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে।

দাম কিছুটা কমতে দেখা গেল প্রতিযোগী হিসেবে ভারতীয় চালের আগমন শুরুর পর। সরকার দুই দফায় শুল্ক কমিয়ে আমদানি সহজ করে। এরপর চাল আসতে শুরু করে। দামও কিছুটা কমে। তারপরও বাংলাদেশেই চালের দাম বেশি। নিম্নবিত্তের বর্তমান দামে চাল কিনে খেতে কষ্ট হয়।

ছয়.

চালের বাজারে বাজার ব্যবস্থাপনাই বেশি কার্যকর। বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য দরকার চাহিদা ও উৎপাদনের নির্ভরযোগ্য তথ্য এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। সেদিকে নজর না দিয়ে মিনিকেট বন্ধ করা নিয়ে বক্তব্য দিলে, সভা করলে গণমাধ্যমে মুখ দেখানো যাবে ঠিকই, তাতে কাজের কাজ কিছুই হবে না।