আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের একটি বড় কারণ মতপ্রকাশে বাধা। দেশে সত্যিকার একটি গণতান্ত্রিক আবহ দরকার, যেখানে বহু রকম মত প্রকাশ করা যাবে। বহুমত প্রকাশের জন্য এখনো নানা রকম ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ৩০ বছর পূর্তি উদ্যাপন অনুষ্ঠানে আলোচকেরা এ কথাগুলো বলেন। রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে গতকাল রোববার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান ১৯৯৩ সালে নীতি পর্যালোচনা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডি প্রতিষ্ঠা করেন। সিপিডির লক্ষ্য ছিল বিস্তারিত ও সুগভীর গবেষণা করা, নীতি পর্যালোচনা করা, সংলাপ আয়োজন করা, যাতে সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির জন্য সুপরামর্শ পায়।
সিপিডির ৩০ বছর পূর্তি উদ্যাপন অনুষ্ঠানে চারটি অধিবেশন ছিল। এসব অধিবেশনে সিপিডির যাত্রা, কার্যক্রম, কাজের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়। এতে সরকারের উপদেষ্টা, রাজনীতিবিদ, সিপিডির ট্রাস্টি, অর্থনীতিবিদ, দেশি-বিদেশি গবেষক, কূটনীতিক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধনী অধিবেশনে সিপিডির প্রতিষ্ঠাকালীন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের একজন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শুভেচ্ছাবার্তার
একটি ভিডিও প্রচার করা হয়। এতে তিনি বলেন, দেশের সাধারণ মানুষের সামগ্রিক অবস্থার পরিবর্তন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের যে চেষ্টা সারা জীবন ধরে তিনি করেছেন, সিপিডির কাজে সব সময় তার প্রতিফলন দেখতে পেয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সিপিডি অতীতের মতো বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান রেখে যাবে।
সিপিডি সব সময় স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করেছে এবং দেশের স্বার্থে নীতিনির্ধারকদের বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছে বলে ভিডিও বার্তায় উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সব সময় সিপিডি সচেষ্ট থেকেছে। তিনি আরও বলেন, ‘সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মনন সৃষ্টিতে সিপিডির গবেষণা ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম অশেষ ভূমিকা রেখেছে। এ কারণে এই প্রতিষ্ঠান সব সময় আমার কাছে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।’
শুভেচ্ছাবার্তায় সিপিডির প্রতিষ্ঠাকালীন ট্রাস্টি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত সবাইকে শুভেচ্ছা জানান ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আমি বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাই সিপিডির প্রতিষ্ঠাতা, আমার শিক্ষক অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে। যিনি দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সময়ে তাঁর ব্যতিক্রমী ভূমিকা রেখে চলেছেন।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। সিপিডির এই যাত্রায় কোন বিষয়টি অনুপ্রাণিত করেছে, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক থাকার সময় নিয়মিত সংলাপের আয়োজন করতেন তিনি। সেই সংলাপে অংশীজনেরা অংশগ্রহণ করলেও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব অনুপস্থিত থাকত। সময়টা ছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমল। বিআইডিএস থেকে অবসরে যাওয়ার পর তিনি একটি জায়গা তৈরি করতে চান, যেখানে প্রাসঙ্গিক সব পক্ষকেই আনা যাবে। তাঁরা সভ্য উপায়ে দেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন।
সরকার, বিরোধী দলসহ সব অংশীজনের সমন্বয়ে গঠনমূলক আলোচনার সূত্রপাত সিপিডি করতে পেরেছিল বলে উল্লেখ করে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, দুঃখজনক হলো গত ১৫ বছরে তা বাধার মুখে পড়েছে। গত সরকারের অর্থমন্ত্রীদের কেউ কেউ সিপিডির সংলাপে অংশ নেননি।
বহুমত প্রকাশের জন্য এখন নানা রকম ঝুঁকি দেখা যায় বলে মন্তব্য করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান। তিনি বলেন, ‘আশা করব, ভবিষ্যতে আমাদের দেশে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকবে। যাতে সিপিডি খুবই নির্ভয়ে সব কাজের আলোচনা-সমালোচনা করতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু সিপিডি নয়, আমাদের দেশে যাতে আসলেই এ রকম একটা গণতান্ত্রিক আবহ থাকে, যেখানে বহুমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারি। কারণ, বহুমত প্রকাশের জন্য এখন নানা রকম ঝুঁকি দেখি। এর পুরোটা যে সরকারের কাছ থেকে আসছে, তা নয়। যাদের একটা মত আছে, তারা অন্যদের মত শুনতে চায় না।’
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ভোটাধিকার কেড়ে নিলে একটার পর একটা অধিকার কেড়ে নিতে হয়। এটা ঠেকাতে মৌলিক বিষয়গুলো ঠিক রাখতে হবে।
কেবল ভোটাধিকার দিয়েও গণতন্ত্র নিশ্চিত করা যায় না বলে উল্লেখ করেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, নির্বাচন যথেষ্ট নয়। গণতন্ত্রকে টেকসই করতে হলে প্রতিনিয়ত জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিক সমাজ, জনগণসহ সব অংশীজনকে তার ভূমিকা পালন করতে হবে।
দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম উল্লেখ করেন যে গত ১৫ বছরে মুক্তচিন্তাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করা হয়েছে। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ রূপ নয়। নিয়মিত জবাবদিহি করতে হবে। প্রতিদিন জবাবদিহি নিশ্চিত করে মুক্ত গণমাধ্যম।
মাহ্ফুজ আনাম বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের অন্যতম কারণ ছিল গণমাধ্যমের গলা চেপে ধরা। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দিলে অনেক তথ্য সরকারের কাছে যেত। সরকার এগুলোকে এড়িয়ে যেতে পারত, না–ও যেতে পারত। বাস্তবতা ছিল, তার কাছে সত্য যেতই না।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, আর্থসামাজিক অবস্থা ভালো না হলে ব্যবসা হয় না। সিপিডি বিষয়টি তুলে ধরে ব্যবসার পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।
জনস্বার্থে গবেষণা হওয়া জরুরি বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার। তিনি বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন ছিল। মজুরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সিপিডির গবেষণায় যেসব তথ্য উঠে আসত, তা আঁকড়ে ধরে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন তাঁরা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
‘বাংলাদেশে কী ঘটছে, তুলে ধরতে পারে সিপিডি’
বিকেলে একটি অধিবেশন ছিল সিপিডির কাজের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব নিয়ে। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থান হওয়ায় গণমাধ্যম, বিশেষ করে ভারতীয় গণমাধ্যম খুবই অখুশি। শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বেই এখন সংঘবদ্ধভাবে প্রোপাগান্ডা (অপপ্রচার) চালানো হচ্ছে। তারা (ভারতীয় গণমাধ্যম) প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন চালানো হচ্ছে, তালেবান ঘরানার সরকার আসতে যাচ্ছে ইত্যাদি, যা খুবই অন্যায্য।’
বাংলাদেশের মানুষ মনে করছে, ভুল না করলেও তাদের ভুক্তভোগী করা হচ্ছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এর নেতিবাচক দিক হলো এসব কোনো পক্ষকেই ভালো কিছু দেবে না। বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না, ভারতের জন্যও ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
দক্ষিণ এশিয়ার বাইরেও সিপিডির ভালো যোগাযোগ আছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সেই যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে সিপিডি তুলে ধরতে পারে যে বাংলাদেশ কী করছে, বাংলাদেশের ভেতরে সত্যিকারের অবস্থা কী।
আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া এখন খুবই কঠিন সময় পার করছে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সম্মাননীয় ফেলো ফারুক সোবহান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালকে যুক্ত করেছে বিবিআইএন প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা মেনে নিতে হবে যে এই প্রক্রিয়াও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে।
এ অধিবেশনে আরও বক্তব্য দেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি বক্তব্য দেন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট গ্রুপের পরিচালক ডার্ক উইলেম তে ভেলডি, ইউনান একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের সাবেক সভাপতি রেন জিয়া, ভারতের রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিজের মহাপরিচালক সচীন চতুর্বেদি, দ্য সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শ্রীধর খত্রি।
অধিবেশনটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।