এডিসি হারুন স্যারকে মেরেছিলেন আমার স্বামী: চ্যানেল আইকে এডিসি সানজিদা
ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নেতাকে থানায় মারধরের ঘটনা নিয়ে মুখ খুলেছেন রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হকের স্ত্রী পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সানজিদা আফরিন। তিনি বলেছেন, এডিসি হারুন অর রশিদকে প্রথমে মেরেছিলেন তাঁর স্বামী রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হক।
চ্যানেল আইয়ের ইউটিউব চ্যানেলে আজ মঙ্গলবার প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে গত শনিবারের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন এডিসি সানজিদা আফরিন।
সাক্ষাৎকারটি আজ বিকেলে প্রচার করা হয়। এর আগে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ঘটনায় এডিসি হারুনের ওপর প্রথম আঘাত করেছিলেন রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার সূত্রপাত যে কারণে হয়েছে, যিনি সূত্রপাত করেছেন, তিনিও (রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক) একজন সরকারি কর্মকর্তা। উনি আমাদের পুলিশের ওপর হামলাটি করেছেন।’
অবশ্য বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁকে একাধিকবার কল করা হয়েছে, খুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে, তবে সাড়া পাওয়া যায়নি।
চ্যানেল আইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এডিসি সানজিদা বলেছেন, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় তিনি বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন। চিকিৎসক দেখাতে সহকর্মী হিসেবে এডিসি হারুনের সহায়তা নেন তিনি। হঠাৎ তাঁর স্বামী আজিজুল হক কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেন। এডিসি হারুন ও তাঁকে মারধর করেন তাঁর স্বামী।
সানজিদা আরও বলেন, তাঁর স্বামীর সঙ্গে থাকা কয়েকজন অসৎ উদ্দেশ্যে দুজনের (এডিসি হারুন ও সানজিদা) ভিডিও করেন। তাঁদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এডিসি হারুন থানা-পুলিশকে খবর দেন। পরে পুলিশ এসে হারুনকে উদ্ধার করে।
ওই দিন সন্ধ্যায় তাঁর স্বামী আজিজুল হক স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না বলেও দাবি করেন এডিসি সানজিদা। তিনি বলেন, ‘সেদিন আমার স্বামী (আজিজুল হক) টোটালি আউট অব মাইন্ড (মানসিক অবস্থা ঠিক ছিল না) ছিলেন।’
ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে সানজিদা আফরিন বলেন, তিনি অনেক দিন ধরেই অসুস্থ। ল্যাবএইডের একজন চিকিৎসককে নিয়মিত দেখান তিনি। তবে ওই চিকিৎসক দেশের বাইরে আছেন। অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় তিনি বারডেমে একজন চিকিৎসক দেখাতে চান। হাসপাতালটির অবস্থান রমনা এলাকার মধ্যে হওয়ার কারণেই চিকিৎসক দেখাতে সহকর্মী এডিসি হারুনের সহায়তা চান। শাহবাগ থানার ওসির (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মাধ্যমে এডিসি হারুন একজন চিকিৎসকের সময় নেন (অ্যাপয়েন্টমেন্ট)। তবে হাসপাতালে এসে জানতে পারেন, ওই চিকিৎসক একটি কনফারেন্সে ব্যস্ত। রোগী দেখতে পারবেন না। বিষয়টি তিনি এডিসি হারুনকে জানান।
জরুরিভাবে চিকিৎসক দেখানো দরকার বলে বিষয়টি এডিসি হারুনকে জানান উল্লেখ করে সানজিদা বলেন, ‘স্যারকে বলি, অন্য কাউকে (চিকিৎসক) ম্যানেজ করা যায় কি না। স্যার আশপাশেই ছিলেন। স্যার বললেন, আমি এসে দেখি কাউকে (চিকিৎসক) ম্যানেজ (দেখানোর ব্যবস্থা) করা যায় কি না। বেশ কিছুক্ষণ পর স্যার আসেন। কয়েকজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেন। পরে একজন ডাক্তারকে দেখাই।’
চিকিৎসক বেশ কিছু পরীক্ষা করতে দেন জানিয়ে সানজিদা বলেন, ‘ইনসিডেন্টের (ঘটনার) সময় আমি ইটিটি করাচ্ছিলাম। ইটিটি (শারীরিক পরীক্ষা) করাতে সময় লেগে যায় ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মতো। ইটিটির শেষ পর্যায়ে রুমের বাইরে হট্টগোল শুনতে পাই। হট্টগোল হচ্ছিল, চিৎকার–চেঁচামেচি হচ্ছিল। প্রথম যে সাউন্ডটা শুনতে পাই, সেটা হলো স্যার (এডিসি হারুন) চিৎকার করে বলছিলেন, ভাই, আপনি আমার গায়ে হাত তুললেন কেন? আপনি তো আমার গায়ে হাত তুলতে পারেন না।’
সানজিদা আফরিন বলেন, ‘প্রথমে ধারণা হয়েছিল, অন্য কারও সঙ্গে একটা ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর দেখতে পাই যে আমার স্বামী...উনি কেন গিয়েছেন, কী করছেন, কিছু জানি না। টোটালি আউট অব মাইন্ড ছিলেন। উনি উত্তেজিত অবস্থায় ছিলেন। ওনার সঙ্গে বেশ কয়েকজন ছেলে ছিল। তাদের আমি চিনি না।’
এডিসি হারুনকে তখন মারতে মারতে পরীক্ষাকক্ষে নেওয়া হয় জানিয়ে সানজিদা বলেন, ‘রুমটার ভেতর নিয়ে আসার সময় তাঁরা স্যারকে (এডিসি হারুন) মারছিলেন। স্যার অনেকটা বাঁচার জন্য ইটিটি রুমের কোনায় গিয়ে দাঁড়ান। ওই সময় আনফরচুনেটলি (দুর্ভাগ্যবশত), আমার হাসব্যান্ড ওই ছেলেগুলোকে বলছিলেন, তোরা এই দুজনের ভিডিও কর।’
সানজিদা আরও বলেন, ‘আমি তখন ইটিটির পোশাকে ছিলাম। আপনারা জানেন যে ইটিটির পোশাক কী রকম থাকে। স্বাভাবিকভাবে পোশাকটি শালীন অবস্থায় ছিল না। আমি হাসব্যান্ডের সঙ্গে শাউট করছিলাম, এই রুমে তো কোনো ছেলে ঢোকার কথা নয়। আপনি ঢুকেছেন, এতগুলো লোক নিয়ে কেন ঢুকেছেন? তো আমি শাউট করছিলাম। তখন তিনি আমাকেও দুই–তিনটি চড় মারেন।’
‘পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, আমার ড্রাইভার (গাড়িচালক) ছুটে আসে। মাঝখানে দাঁড়ায়। ড্রাইভারের ওপর দিয়ে আমার গায়ে হাত তোলা হয়,’ সাক্ষাৎকারে বলেন সানজিদা।
সানজিদা আরও বলেন, ‘একটা পর্যায়ে যাঁরা ভিডিও করছিলেন, একটা ছেলে। আমি হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। তাঁর সঙ্গে হাতাহাতি, এমন একটা সিচুয়েশন (পরিস্থিতি) তৈরি হয়ে যায়। আমি কোনো অবস্থাতেই চাচ্ছিলাম না, ওই পোশাকে আছি, এই অবস্থায় ভিডিও হোক।’
সানজিদা আরও বলেন, ‘ইনটেনশন (উদ্দেশ্য) দেখে মনে হয়েছে, তাঁরা দুজনকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে একটা ভিডিও করতে চাচ্ছেন। পরবর্তীতে তাঁরা সেটি ইউজ (ব্যবহার) করবেন, একটি অসৎ উদ্দেশ্যের জন্য।’
বারডেম থেকে ধরে শাহবাগ থানায় নিয়ে ছাত্রলীগের তিন নেতাকে মারধরের ঘটনায় এডিসি হারুনকে গতকাল সোমবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এডিসি সানজিদা বিষয়টি নিয়ে এই কদিন কোনো কথা বলেননি। রোববার প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, চিকিৎসার জন্য তিনি বারডেমে গিয়েছিলেন।
ভুক্তভোগী ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের রোববার বলেছেন, তাঁরা বারডেমে গিয়েছিলেন তাঁদের এলাকার (গাজীপুর) বড় ভাই রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুলের ডাকে।
এডিসি সানজিদার বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে মারধরের শিকার হওয়া ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, এডিসি সানজিদার সাক্ষাৎকার তিনি দেখেছেন। খুবই অবাক হয়েছেন।
শরীফ আহমেদ বলেন, ‘আমরা গিয়ে দেখি, বিষয়টি পারিবারিক। তখন আমরা কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করিনি। কাউকে মারধর তো প্রশ্নই আসে না। কারও ভিডিও আমরা করিনি।’