ঘটনার আগে মুজিবকে সতর্ক করা হয়েছিল

পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের আগে সম্ভাব্য সেনা অভ্যুত্থান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ও শুভানুধ্যায়ীদের সব আশঙ্কা অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু তখন প্রচণ্ড আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে বলতেন, ‘ওরা (সেনাসদস্যরা) আমার সন্তান, আমার কোনো ক্ষতি ওরা করবে না।’ প্রথমা থেকে প্রকাশিত মিজানুর রহমান খানের লেখা মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড বইয়ে এ-সংক্রান্ত নানা তথ্য-উপাত্ত স্পষ্টভাবেই উল্লেখ আছে।

আর এন কাও আগেই সতর্ক করেন

একজন রাষ্ট্রপ্রধানের তুলনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল খুব সাধারণ। ট্রাফিক সিগন্যালে তাঁর গাড়ি থামত। গাড়ির জানালার কাচ নামানো অবস্থায় তাঁকে কখনো কখনো পত্রিকা পড়তে দেখা গেছে। ছবিটি ১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যাওয়ার পথে
ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৫ সালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) প্রধান দায়িত্বে ছিলেন রমেশ্বর নাথ কাও। ১৯৮৯ সালে ভারতের কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠীর ইংরেজি সাপ্তাহিক সানডের এপ্রিল ২৩-২৯ সংখ্যায় তিনি এক অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে লেখেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল অসন্তুষ্ট সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে, এই তথ্য আমরা আগেই পেয়েছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি নিয়ে আমি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলি।

তাঁকে এও বলেছিলাম যে খুবই সতর্কতার সঙ্গে আমাদের কাছে খবরটা পৌঁছানো হয়েছে। যিনি এ খবর দিয়েছেন, যেকোনো মূল্যে তাঁর পরিচয় গোপন রাখতে হবে। ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতি নিয়েই ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আমি ঢাকায় যাই। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার শেষ বৈঠকের একপর্যায়ে তাঁকে বঙ্গভবনের বাগানে একান্তে কিছু সময় দেওয়ার অনুরোধ করি। সেখানেই তাঁর প্রাণনাশের আশঙ্কা প্রসঙ্গে আমাদের জানা তথ্য সম্পর্কে তাঁকে জানাই। তিনি হাত নেড়ে বলেন, “তারা আমার নিজের সন্তান, তারা আমার ক্ষতি করবে না।”’ বঙ্গবন্ধু কাওয়ের কথায় গুরুত্ব দেননি। 

১৯৭৫ সালের মার্চে আর এন কাও ‘র’-এর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে আবারও বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠিয়েছিলেন। কাও লিখেছেন, ‘তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদাতিক ও অশ্বারোহী ইউনিট তাঁর প্রাণনাশের চক্রান্ত করছে, এ কথা তাঁকে জানিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শেখ মুজিব সব সতর্কতা অগ্রাহ্য করেছিলেন।’ 

সম্ভাব্য অভ্যুত্থান সম্পর্কে বিদেশি পত্রিকায় নিবন্ধ

সেনাসদস্যদের সম্ভাব্য অভ্যুত্থান সম্পর্কে বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ভিনদেশি পত্রিকায়। এই তথ্য পাওয়া যায় তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমদের লেখায়। ক্রিটিক্যাল টাইমস: মেমোয়ার্স অব আ সাউথ এশিয়ান ডিপ্লোম্যাট (দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৭) বইতে তিনি লিখেছেন, ‘পনেরো আগস্টের দুই সপ্তাহ আগে আমি সুইডেন থেকে প্রকাশিত একটি বিশেষ নিবন্ধ সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করেছিলাম। সেখানে সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ ও সেনাসদস্যদের অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ ছিল। তিনি আমার কথায় গুরুত্ব দেননি। বলেছিলেন, সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে ফোন করে তিনি ব্যাপারটা দেখতে বলবেন।’ 

সতর্কবার্তা আসে কানাডা থেকেও

সতর্কবার্তা এসেছিল কানাডা থেকেও। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত গণভবনে উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে কর্মরত ছিলেন মনোয়ারুল ইসলাম। এম নজরুল ইসলাম সম্পাদিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মারকগ্রন্থ ৩-এ উল্লেখ আছে, পঁচাত্তরের প্রথম দিকে মনোয়ারুল ইসলাম কমনওয়েলথ মিটিংয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে কানাডার রাজধানী অটোয়ায় গিয়েছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বাবা) তাঁকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘জানো, আমি শেখ মুজিবকে ভালোবাসি।

তাঁর চোখের ঝিকিমিকি আমার খুব ভালো লাগে। তাঁর বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। তাঁকে বলবে আমার কথা! আমি বলেছি তাঁকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। জীবনের ঝুঁকি আছে। তুমি কথা দাও, এ কথাটা দেশে ফিরেই তুমি তাঁকে বলবে।’ মনোয়ারুল ইসলাম এ কথা বঙ্গবন্ধুর কানে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব জীবনের ভয়ে সৈন্য আর পুলিশের পাহারায় জনগণ থেকে দূরে থাকবে, সেখানে কেউ আসার সাহস পাবে না, এমন জীবন তো আমি চাই না।’ 

সতর্ক করেছিল যুক্তরাষ্ট্রও

তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার এবং নিকটপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলফ্রেড আথারটনের কথোপকথন থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রও বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিল। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সন্ধ্যা সাতটায় (ওয়াশিংটনে স্থানীয় সময় সকাল আটটা) কথা হচ্ছিল দুজনের মধ্যে। 

কিসিঞ্জার: আমরা কি তাঁকে জানাইনি? 

আথারটন: আমরা তাঁকে বলেছিলাম। 

কিসিঞ্জার: কে বা কারা এটা করতে পারে, সে বিষয়ে একটা ধারণা কি আমরা তাঁকে দিইনি? 

আথারটন: আমরা তাঁকে নামধাম বলেছিলাম কি না, তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে...তিনি (মুজিব) তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। বলেন, তাঁর সঙ্গে এমন কিছু কেউ করতেই পারে না। (মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড, মিজানুর রহমান খান, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩) 

পঁচাত্তরে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে কর্মরত ছিলেন স্টিফেন আইজেনব্রাউন। তিনি দাবি করেন, ১৯৭৫ সালের জুলাইয়ের শেষ বা আগস্টের শুরুর দিকে শেখ মুজিবকে সতর্ক করতে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টারকে তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছিল। 

একজন রাষ্ট্রপ্রধানের তুলনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল খুব সাধারণ। ট্রাফিক সিগন্যালে তাঁর গাড়ি থামত। গাড়ির জানালার কাচ নামানো অবস্থায় তাঁকে কখনো কখনো পত্রিকা পড়তে দেখা গেছে। বোস্টার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আপনি যদি তাঁকে দেখতে যান, তাহলে দেখবেন অবাক দৃশ্য। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা লোকজন তাঁকে দেখতে ভিড় করে আছে। আমি নিজে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অভিভূত হয়েছি।’ (গ্রন্থিত)

তথ্যসূত্র: ফখরুদ্দীন আহমেদের ক্রিটিক্যাল টাইমস: মেমোয়ারস অব আ সাউথ এশিয়ান ডিপ্লোম্যাট, এম নজরুল ইসলাম সম্পাদিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মারকগ্রন্থ ৩, মিজানুর রহমান খানের মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড

প্রথম আলো, ১৫ আগস্ট ২০১৮