মুজিববাহিনীর সত্য–মিথ্যা
১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনে যান। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় আটক থাকা অবস্থায় তাঁর মামলা পরিচালনার জন্য যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাঙালিরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা বিখ্যাত আইনজীবী টমাস উইলিয়ামকে শেখ মুজিবের কৌঁসুলি হিসেবে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। লন্ডনে শেখ মুজিবের একটা ‘ইন্ডিয়া কানেকশন’ হয়। সেখানে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর কর্মকর্তা ফণীন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর। সংশ্লিষ্ট মহলে তিনি নাথবাবু নামে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে আসন্ন রাজনৈতিক পালাবদলের সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছিল।
শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে এসে তাঁর আস্থাভাজন চার যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে একসঙ্গে কাজ করতে এবং প্রস্তুতি নিতে বলেন। তিনি তাঁর দল আওয়ামী লীগের চেয়েও এই চারজন তরুণের ওপর নির্ভর করতেন বেশি। মুজিবের প্রতি তাঁদের প্রশ্নাতীত আনুগত্য ছিল।
এ সময় বিএলএফ (বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স) নামটির উদ্ভব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে সিরাজুল আলম খানকে কেন্দ্র করে ১৯৬০–এর দশকে একটা ‘নিউক্লিয়াস’ কাজ করত। তাঁরা একটা ফোরাম তৈরি করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’। যদিও এর কোনো দালিলিক সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। এরপর তৈরি হলো বিএলএফ। সিরাজুল আলম খানের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘আমাদের রাজনৈতিক সংগঠন হলো স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ এবং সামরিক সংগঠন হলো বিএলএফ।’
তোফায়েল আহমেদের ভাষ্য অনুযায়ী, বিএলএফের জন্ম ১৯৬৯ সালের শেষে অথবা ১৯৭০ সালের শুরুর দিকে। ওই সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদী স্লোগানগুলো ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো, ‘জাগো জাগো/ বাঙালি জাগো’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা/ বাংলা বাংলা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা/ ঢাকা ঢাকা/, ‘তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা’। এরপর এল আরও দুটো স্লোগান, ‘জয় বাংলা’ এবং ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ দেশে তখন জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের একতলায় মেয়েদের কমনরুমের সামনের করিডরের দেয়ালে ছোট করে কেউ লিখে দিয়েছিল, ‘বিএলএফে যোগ দিন’।
১৯৭০ সালের মাঝামাঝি ছাত্রলীগের বাছাই করা একদল কর্মীর অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যাওয়ার কথা। শেখ মুজিব নিজেই এর আয়োজন করেছিলেন। কলকাতা থেকে যোগাযোগ করতেন ‘র’-এর অপারেটিভ চিত্তরঞ্জন সুতার। তাঁর বাড়ি পিরোজপুর জেলায়। কলকাতার ভবানীপুরে একটা তিনতলা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল ‘র’। সুতার এই বাড়িতে সপরিবার থাকতেন। মুজিবের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হতো সিরাজগঞ্জের তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা এবং একসময় ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু হেনার মাধ্যমে।
শেখ মুজিব ভেবেছিলেন, ইয়াহিয়া নির্বাচন দেবেন না। দেশ স্বাধীন করার জন্য ছাত্রলীগের কর্মীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের চিন্তাভাবনা হচ্ছিল। ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে একটি ব্যাচের বাছাই প্রক্রিয়াধীন ছিল। ১৯৭০ সালের আগস্টে মুজিবের মনে এই প্রতীতি জন্মে যে নির্বাচন হবে। তখন প্রশিক্ষণ স্থগিত করা হয়। বলা হয়, এখন এটার আর দরকার নেই।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ এবং ১৭ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একচেটিয়া জয় পায়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই সংবিধান প্রশ্নে অচলাবস্থা দেখা দেয়। মুজিবের মনে আশঙ্কা, সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হবে না।
১৮ ফেব্রুয়ারি মুজিব তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের চার সদস্য—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং চার যুবনেতা—মনি, সিরাজ, রাজ্জাক ও তোফায়েল। হাইকমান্ডের অপর সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদ উপস্থিত ছিলেন না কিংবা তাঁকে ডাকা হয়নি। শেখ মুজিব কাগজে একটি ঠিকানা দেখিয়ে তাঁদের মুখস্থ করান। এরপর কাগজটি কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলেন। তিনি উপস্থিত সবাইকে বলেন, দরকার পড়লে তাঁরা যেন ওই ঠিকানায় যোগাযোগ করেন। ঠিকানাটি হলো—সানি ভিলা, ২১ রাজেন্দ্রপ্রসাদ রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা। পাকিস্তানের রাজনীতির হাওয়া দেখে মুজিব কয়েকটি ‘অপশনের’ কথা ভেবে রেখেছিলেন। এটি ছিল তার একটি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের বাস্তবায়ন শুরু করে। বাঙালির ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণ চলতে থাকে। শেখ মুজিব মাঝরাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারের আগে তিনি কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে যাননি। শুধু সবাইকে নিরাপদে সরে যেতে বলেছিলেন। ১৮ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে উপস্থিত যুবনেতারা এবং মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান এপ্রিলে সানি ভিলায় গিয়ে হাজির হন। সৈয়দ নজরুল ময়মনসিংহ হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে মেঘালয়ের তুরায় আশ্রয় নেন। তাজউদ্দীন কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করে তাঁর নিজস্ব চ্যানেলে যোগাযোগের মাধ্যমে দিল্লি যান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী করে একটি সরকার গঠন করেন।
তাজউদ্দীন কলকাতা ফিরে এলে যুবনেতাদের তোপের মুখে পড়েন। তাঁরা বলেন, তাজউদ্দীন লিডারের (মুজিব) অপশনের বাইরে গিয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করেছেন। এটা তাঁরা মেনে নেবেন না। তাঁরা একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন। কারণ, লিডার তাঁদের এই দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।
১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামে বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠান হয়। ১৮ এপ্রিল সিদ্ধান্ত হয়, মুক্তিযোদ্ধা বাছাইয়ের দায়িত্বে থাকবেন এই যুবনেতারা। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। মুক্তিফৌজের প্রধান কর্নেল ওসমানী বেঁকে বসেন। যুবনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় নাথবাবুর। তিনি তখন র-এর পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে। ভারত সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়। প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিল র-এর অধীন স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (এসএফএফ)। এর ইন্সপেক্টর জেনারেল হলেন মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান। উল্লেখ্য, ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের সময় সীমান্ত পেরিয়ে চীনা ভূখণ্ডে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালাতে তিব্বতি শরণার্থীদের নিয়ে এই বাহিনী তৈরি হয়েছিল। এটির পরিচালনায় ছিল ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ (আইবি)। ১৯৬৮ সালে আইবি ভেঙে দুটি সংস্থা করা হয়। একটি থেকে যায় আইবি নামে। অন্যটির নাম হয় আরডব্লিউএ বা র (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং)। আইবির ‘পাকিস্তান ডেস্ক’ একটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের নাম ‘বাংলাদেশ’। এটি ন্যস্ত হয় র-এর ওপর। দায়িত্ব পান নাথবাবু।
বিএলএফের প্রশিক্ষণ শুরু হয় মে মাসে। চলে অক্টোবর পর্যন্ত। সাত থেকে দশ হাজার তরুণকে ভারতের দুটি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অক্টোবরে শেষ ব্যাচের প্রশিক্ষণের সময় বিএলএফের নাম পরিবর্তন করে মুজিববাহিনী রাখা হয়।
প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চালকের আসনে শুরু থেকেই ছিল র। যে রাতে তাজউদ্দীন ইন্দিরার সঙ্গে প্রথম দেখা করেন, সেখানে অন্যান্যের মধ্যে আইবির পাকিস্তান ডেস্কের প্রধান এস শঙ্করণ নায়ার উপস্থিত ছিলেন। তিনি কর্নেল মেনন নামে ১৯৬৭ সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্রের’ উদ্যোক্তা পাকিস্তান নৌবাহিনীর কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের প্রতিনিধি আলী রেজা এবং স্টুয়ার্ড মুজিবের সঙ্গে অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে বৈঠক করেছিলেন। বৈদ্যনাথতলায় (তাজউদ্দীন নাম দেন মুজিবনগর) শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরনের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন নাথবাবু। নেপথ্যে থেকেই কাজ করতেন তিনি।
বাংলাদেশ সরকারের অধীনে মুক্তিফৌজের বাইরে বিভিন্ন দলের নিজস্ব বাহিনী ছিল। এই বাহিনীগুলোর লক্ষ্য ছিল নিজ দলের রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা। এদের মধ্যে ছিল ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের বাহিনী, অমল সেন-জাফর-মেননদের দলীয় বাহিনী—যার একটি ঘাঁটি ছিল নরসিংদীর শিবপুরে, আবদুল হকের পার্টির নূর মোহাম্মদের নেতৃত্বে যশোরে ইপিসিপির বাহিনী (যদিও আবদুল হক এপ্রিলের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন), মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুরে ইপিসিপির বাহিনী, সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে ঝালকাঠির পেয়ারাবাগানে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির বাহিনী। এর বাইরে ব্যক্তি উদ্যোগে আরও কয়েকটি বাহিনী গড়ে উঠেছিল, যেমন কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, বাতেন বাহিনী, আফসার বাহিনী ইত্যাদি। নিজের নামে বাহিনী করার প্রবণতা প্রবাসী সরকারের মধ্যেও ছিল। যেমন জিয়াউর রহমানের ‘জেড ফোর্স’, সফিউল্লাহর ‘এস ফোর্স’ এবং খালেদ মোশাররফের ‘কে ফোর্স’।
বিএলএফ তথা মুজিববাহিনী ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গঠিত একটি বাহিনী। এর লক্ষ্য ছিল মুজিবের ‘আদর্শ’ প্রতিষ্ঠা করা। আশঙ্কা ছিল, মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে জীবিত না–ও ফিরতে পারেন। সে ক্ষেত্রে মুজিববাহিনী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করবে। এই বাহিনী প্রবাসী সরকারের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেছিল। তাদের মতে, এই সরকার গঠিত হয়েছিল শেখ মুজিবের ইচ্ছার বাইরে।
মুজিববাহিনীর সঙ্গে সরকারের কমান্ডে থাকা মুক্তিফৌজের—যাদের বলা হতো ফ্রিডম ফাইটার (এফএফ)—কোথাও কোথাও এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। আবার অনেক জায়গায় তারা একসঙ্গে লড়াই করেছে। এটি নির্ভর করত স্থানীয় নেতৃত্বের ওপর। কোথাও কোথাও কমিউনিস্ট পার্টির বাহিনীগুলোর সদস্যদের সঙ্গে মুজিববাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে। যাদের যেখানে জোর বেশি, তারা সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর চড়াও হয়েছে। সবই ছিল দলীয় রাজনৈতিক ঝগড়া।
১৯৭১ সালের প্রাক্কালে দেশের সবচেয়ে বড় ছাত্রসংগঠন ছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু ছাত্রলীগের বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন এফএফ। বিএলএফ ছিল গোপন সংগঠন। কোথায় কীভাবে কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, এটা বেশির ভাগ তরুণই জানতেন না। যাঁরা যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
মুজিববাহিনী নিয়ে সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তি হলো, এটা ভারতের মাটিতে জেনারেল উবানের তৈরি বলে প্রচার করা। এই প্রচারটি সচরাচর করেন মুজিববিরোধী কিছু বাম দলের লোকেরা। একাত্তরে শেখ মুজিবের পাহাড়সম জনপ্রিয়তা ছিল এবং তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরা তাঁর প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ ছিলেন। মুজিববাহিনী নিয়ে বিরোধীদের মোটাদাগে তিনটি সমালোচনা আছে। প্রথমত, এটি র-এর তৈরি। দ্বিতীয়ত, এরা মুক্তিযুদ্ধ করেনি। তৃতীয়ত, এদের লক্ষ্য ছিল কমিউনিস্ট নিধন। সমালোচনাগুলো কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে আলোচনা করা যায়।
প্রথমত, ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের যত প্রশিক্ষণ হয়েছে, সবার নেপথ্যেই ছিল র। র পুরো বিষয়টিরই সমন্বয় করেছে। এটি ছিল ভারত সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত। সমন্বয়ক ছিলেন ওপরে র প্রধান আর এন কাও এবং মাঠে নাথবাবু। সুতারের বাড়িতে মুজিববাহিনীর চার কমান্ডার বৈঠক করতেন। সুতারের হিন্দু পাচক মুসলমানকে খাবার পরিবেশন করবে না জেনে চারজন নতুন নাম নেন: মনোজ (মনি), সরোজ (সিরাজ), রাজু (রাজ্জাক), তপন (তোফায়েল)।
দ্বিতীয়ত, যুদ্ধ বিষয়টি এত সহজ নয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা সংখ্যা ও অস্ত্রে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেননি। একপর্যায়ে সবাই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান। সীমান্তজুড়ে তাঁদের অনেকগুলো ক্যাম্প ছিল। সেখান থেকে তাঁরা প্রথমে বিএসএফ এবং পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে দেশের ভেতরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালাতেন। ওই সময় গ্রামগুলো ছিল মুক্ত আর শহরগুলো অবরুদ্ধ। যুদ্ধ করতে হলে শহরে রেইড করতে হতো। অত্যন্ত সীমিত অস্ত্র দিয়ে সেটি সম্ভব ছিল না। একটা উদাহরণ দিই। মুজিববাহিনীর ১২ জনের একটি দলকে একটি এলএমজি দেওয়া হতো। এটা দিয়ে কোনো শহর দখল করা সম্ভব নয়। ডিসেম্বরে ভারতীয় বাহিনী দেশে ঢোকার আগে মুক্তিযোদ্ধারা কোথাও কোনো শহরের দখল নিতে পারেননি। ঢাকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁরা কেউ একজন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাকেও হত্যা কিংবা গ্রেপ্তার করতে পারেননি। এটাই বাস্তবতা। সমতলে ঘাঁটি বানিয়ে টিকে থাকা যায় না। সিরাজ সিকদারের পেয়ারাবাগানের সব গাছ ছারছিনার মাদ্রাসার ছাত্ররা কেটে দিলে তাঁদের সবাইকে সেখান থেকে সরে আসতে হয়েছিল। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির লাইন অনুসরণ করে গ্রামে ঘাঁটি বানিয়ে শহর ঘেরাও করে বিপ্লব করে ফেলার কথা শুধু এ দেশের পার্টিগুলোর দলিলেই লেখা। বাস্তবে এটা সম্ভব নয়। কেউ পারেনি।
তৃতীয়ত, মুজিববাহিনীর মধ্যে কমিউনিস্ট–বিরোধিতা ছিল। কারণ, তারা মনে করত, কমিউনিস্টরা মস্কো-পিকিংয়ের প্রেসক্রিপশন নিয়ে কাজ করেন। তারা স্বাধীন নয়। তারা, বিশেষ করে কয়েকটি পিকিংপন্থী দল, মুজিববাহিনীকে শত্রুজ্ঞান করে তাদের নির্মূল করতে চাইত। যে যেখানে পেরেছে, কল্পিত শত্রুকে ঘায়েল করেছে।
বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধ করেছে দেশ স্বাধীন করে বৈষম্য দূর করার জন্য। ভারত একটা ‘গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি’ নিয়ে তার ওপর সওয়ার হয়েছে। ভারত চেয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সীমিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়ে পাকিস্তানিদের ব্যতিব্যস্ত রাখা ও তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। সেটি হয়েছে। এক মাহেন্দ্রক্ষণে একটি যৌথ বাহিনীর ঘোষণা দিয়ে ভারতের সামরিক বাহিনী বসে গেছে চালকের আসনে।
যুদ্ধ একদিন শেষ হলো। শেখ মুজিব বীরের বেশে দেশে ফিরে এলেন। মুজিববাহিনীর স্বাভাবিক মৃত্যু হলো। কেউ কেউ বলেন, মুজিববাহিনীর সদস্যদের দিয়ে পরে রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছিল। এই তথ্য ঠিক নয়। রক্ষীবাহিনীতে মুজিববাহিনীর কিছু সদস্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। ছাত্রলীগের যাঁরা মুজিববাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ফিরে গেছেন যাঁর যাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
নাথবাবুর কী হলো? ১৯৭২ সালে ঢাকার একটি হোটেলে তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। এটা নিয়ে বাংলাদেশ বা ভারতে কোনো হইচই হয়নি, কেউ উচ্চবাচ্য করেনি। নাথবাবুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইতিহাসের একটা অধ্যায় চিরদিনের জন্য চাপা পড়ে গেছে।
তথ্যসূত্র
১. জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি; মহিউদ্দিন আহমদ; প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
২. প্রতিনায়ক: সিরাজুল আলম খান: নিউক্লিয়াস মুজিববাহিনী জাসদ; মহিউদ্দিন আহমদ; প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
৩. এই দেশে একদিন যুদ্ধ হয়েছিল; মহিউদ্দিন আহমদ; প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা;