চলন্ত ট্রেনে ধর্ষণের শিকার কিশোরীকে নিয়ে আর গ্রামে ফিরতে চান না বাবা। কারণ, হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কী করবাম? মাইনষে নানা কথা কইব। এইতা (এসব) তো আমার ছেড়ি (মেয়ে) সইতে পারত না।’
গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকা থেকে লালমনিরহাটগামী ‘লালমনি এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ভুলবশত উঠে পড়ে ধর্ষণের শিকার হয় ওই কিশোরী (১৪)। পরদিন বুধবার কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে ওই ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট আক্কাস গাজীকে (৩২) গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সমাজের মানুষের কটু কথার যে ভয় থেকে ওই বাবা মেয়েকে নিয়ে গ্রামে ফিরতে চান না, সেই ভয়ের মধ্যে বাস করে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে ধর্ষণের শিকার আরেক নারী, তাঁর বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের। ২০২২ সালের ২ আগস্ট দিবাগত রাতে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল পরিবহনের চলন্ত বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। টাঙ্গাইলের মধুপুরে বাসটিকে ফেলে যায় ডাকাতেরা। চলন্ত বাসে ডাকাতির সময় একমাত্র প্রতিবাদ করা ব্যক্তি ছিলেন ওই নারী। তিনি পোশাক কারখানায় কাজের খোঁজে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিলেন। ওই নারী ডাকাত দলের দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন।
দেড় বছর আগের সেই ঘটনায় হওয়া মামলা এখনো সাক্ষ্য পর্যায়ে। বিচারের এই ধীরগতি নিয়ে হতাশা রয়েছে ওই নারীর। এর মধ্যে কটু কথা সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ায় তাঁকে।
‘বাবা-মাকে কথা শোনায়’
গত বছরের নভেম্বর থেকে ওই নারীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সর্বশেষ আজ শুক্রবার কয়েক দফায় ওই নারীর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। তাঁর চাওয়া, ধর্ষকদের যেন ফাঁসি হয়। তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায়। তিন বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়।
আজ ওই নারী (৩৫) বলেন, এক মাস ধরে তিনি গ্রামের বাড়ি ছেড়ে কুষ্টিয়া শহরে আছেন। কেন এসেছেন জানতে চাইলে বলেন, কাজ খুঁজছেন। পরিচিত এক বড় বোনের বাসায় উঠেছেন। সেখানে থেকেই কাজ খুঁজছেন। কাজ ছাড়া তাঁর জন্য জীবন ধারণ করা কঠিন হয়ে গেছে। গ্রামের লোকজন সারাক্ষণ কথা শোনায়। কাজ থাকলে এসব কথা তা-ও গায়ে কম মাখতে পারতেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৯ হাজার ৫৬টি, ২০২১ সালে ২২ হাজার ১২৪টি, ২০২০ সালে ২২ হাজার ৫০১টি, ২০১৯ সালে ২৭ হাজার ৭৫২টি, ২০১৮ সালে ১৬ হাজার ২৩৪টি মামলা হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ১৮ হাজার ৫৩টি মামলা হয়েছে। ২০২৩ ও ২০২২ সালে মামলার ৫২ শতাংশ ছিল ধর্ষণের, আগের চার বছরে এ হার ৪৮ শতাংশের নিচে ছিল।
এক প্রশ্নের জবাবে ওই নারী বলেন, ‘গ্রামে বাবা-মায়ের সঙ্গে আশপাশের কারও সামান্য কথা-কাটাকাটি হোক, আর ঝগড়া হোক, আমার ঘটনার কথা তুলে এনে বাবা-মাকে কথা শোনায়। বলে, তোর মেয়ে “জরিমানা”(ধর্ষণের দুর্ভোগ) নিয়া ফিরছে। আমাকেও কথা শোনায়। যতই বলি, আমার কী দোষ? ওটা তো একটা দুর্ঘটনা। ওটায় কি আমার কোনো হাত আছে? কিন্তু কে শোনে কার কথা! ওদের কথা ওরা বলতেই থাকে।’
ধরা গলায় তিনি বলেন, ‘ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছা করে না। একটা কাজ কেউ দিলে খুব উপকার হতো। বাবা-মায়ের ওপর খাই। বুঝছেন, আমার বাবা-মা এত গরিব, আর এত সহজ-সরল! ওরা এই দুনিয়ার কিছুই বোঝে না। আমার পরিবারের মধ্যে আমিই একটু পড়াশোনা করেছি (পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত)। আমিই একটু দিন-দুনিয়া বুঝি।’
ওই নারীর ভাষায়, তাঁর ‘কপালটাই পোড়া’। সব সময় তাঁর সঙ্গে খারাপ কিছুই ঘটে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল পাশের গ্রামে। তিন বছর টিকে ছিল সেই বিয়ে। স্বামীর সঙ্গে যখন বিচ্ছেদ হয়, তখন একমাত্র সন্তানের (ছেলে) বয়স ১ বছর ১১ দিন। ছেলে দাদির কাছে থাকে। ছেলের বাবা আবার বিয়ে করেছে। ছেলের বয়স এখন ১০ বছর। প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তিনি নারায়ণগঞ্জে একটা পোশাক কারখানায় হেলপারের চাকরি নেন। সেখানে এক ঠিকাদারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ের এক বছর পর থেকে সেই স্বামী যোগাযোগ করা বন্ধ করে দেয়। আট বছর ধরে কোনো যোগাযোগ নেই। এর মধ্যে বিরতি দিয়ে দিয়ে তিনি কখনো নারায়ণগঞ্জ, কখনো গাজীপুরের পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। বাসে ধর্ষণের ঘটনার কয়েক মাস আগে তিনি অসুস্থ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ থেকে চাকরি ছেড়ে গ্রামে বাবা-মায়ের কাছে ফিরেছিলেন।
ওই নারী বলেন, ‘বুঝছেন, কপাল মন্দ হলে কোথাও সুখ হয় না।’
বিচারের ধীরগতি, আগ্রহী নন বাদী
বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনার কথা তুলে ধরে ওই নারী বলেন, বাসে যাত্রী ছিলেন ২৪ জন। আর ডাকাত ১১ জন। অস্ত্রের ভয়ে সবাই চুপ ছিলেন। বলেন, ‘একমাত্র আমিই প্রতিবাদ করছিলাম। আমার গায়ে হাত দেওয়ার পর চিৎকার করে বলছিলাম, তোদের মা-বোন নাই? অন্য নারীদেরও নির্যাতন করা হইছে। কিন্তু কেউ কিছু বলে নাই। আর দু-তিনজন প্রতিবাদ করলেই হয়তো ডাকাতেরা এত সাহস পাইত না।’
তিনি বলেন, ‘আমি ধর্ষকদের ফাঁসি চাই। তাঁদের ফাঁসি হওয়া ছাড়া আমার আর কোনো চাওয়া নেই। এমন নির্যাতন করার সাহস যেন কেউ না পায় আর।’
বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের মামলায় বাদী হয়েছিলেন মো. হেকমত আলী (২৮) নামের বাসের এক যাত্রী। তবে তিনি মামলাটির বিষয়ে আর আগ্রহী নন। এর আগে গত ২০ নভেম্বর মো. হেকমত আলী (২৮) প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামিরা কোথায়, মামলার কী অবস্থা আমি কিছু জানি না। আমি ওই ঘটনা ভুলে যেতে চাই। ঘটনার আড়াই মাস পর সাক্ষী দিতে থানায় গিয়ে ভালো ব্যবহারও পাইনি।’
ধর্ষণের শিকার নারীর প্রসঙ্গ তুলতে তিনি বলেন, ‘অস্ত্রের সামনে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কারও প্রতিবাদ করার অবস্থা ছিল না। ওই নারীর মতো আরও কয়েকজন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বাধা দিতে পারিনি মনে হলে খারাপ লাগে।’
মামলা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেন ওই নারী। তিনি বলেন, তাঁকে বাদী করলে ভালো হতো। তাঁর সঙ্গে মামলার বিষয় নিয়ে থানা থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি। গত ৩১ ডিসেম্বর তিনি ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করলে ওসি তাঁকে বিচারের বিষয়ে আশ্বস্ত করেন।
ওই নারী একই সময়ে মামলার বাদীর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন বলে জানান। তিনি বলেন, বাদী বলেন, ৩১ ডিসেম্বর তাঁর (বাদীর) সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালতে হাজির হওয়ার তারিখ ছিল। কিন্তু তিনি যাননি। মামলার পরের তারিখ ২৪ জানুয়ারি। সেদিন যাবেন।
ওই নারী বলেন, ‘বাদী এই তারিখেও সাক্ষ্য দিতে যাবেন কি যাবেন না, বুঝতে পারছি না। এ রকম হলে বিচার কি তাড়াতাড়ি হবে?’
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে টাঙ্গাইলের গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) ওসি মো. হেলাল উদ্দিন আজ প্রথম আলোকে বলেন, ১১ জন ডাকাতের মধ্যে ৪ জন ধর্ষণ করে বলে ডিএনএ পরীক্ষায় এসেছে। ডাকাতি, ধর্ষণ ও ধর্ষণের সহযোগী হিসেবে ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
আসামিরা কারাগারে আছেন কি না, জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘সর্বশেষ এক মাস আগের কথা জানি যে আসামিরা কারাগারে আছে।’ সাক্ষ্য নিয়ে, বিচার নিয়ে ধীরগতির প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের দিক দিয়ে খুব জোরালোভাবে তদন্তের পর অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বিচারের দায়িত্ব আদালতের।’
কথার শেষ পর্যায়ে ওই নারী দুটো অনুরোধ জানান, ‘আপনারা বিচারের ব্যবস্থা করেন। আর দয়া করে আমার জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করেন। কুষ্টিয়া, পাবনা, ঝিনাইদহ যেকোনো জায়গায় আমাকে একটা কাজ দিলেও হবে।’