বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে দেওয়া সাজা বহাল রাখার আরজি জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। আজ বুধবার ওই মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিল শুনানিতে তিনি এ আরজি জানান।
বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ শুনানি গ্রহণ করেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার শুনানির দিন রয়েছে।
শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে জাতির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। বিবেকবান মানুষ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বিচারিক আদালতের রায়ে ভুল নেই। আর সাজা যদি বহাল না থাকে, ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো মেধাবী শিক্ষার্থীকে তাঁর মা–বাবা পাঠাতে সাহস করবে না, নৈরাজ্যবাদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে। এ ঘটনার যথাযথ বিচার না হলে সমাজে ভুল বার্তা যাবে। সে কারণে বিচারিক আদালতের সাজা বহাল চান তিনি।
এর আগে ওই মামলায় ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর রায় দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক। রায়ে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। অন্যদিকে বিচারিক আদালতের রায়ের পর কারাগারে থাকা দণ্ডিতরা কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জেল আপিল ও আপিল করেন। আসামিদের এই ডেথ রেফারেন্স, জেল আপিল ও আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি চলছে। পেপারবুক থেকে উপস্থাপনের পর গতকাল রাষ্ট্রপক্ষ আপাতত যুক্তি উপস্থাপন শেষ করে।
আজ দিনের প্রথমার্ধে আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলামের পক্ষে আইনজীবী আজিজুর রহমান শুনানি করেন। মধ্যাহ্ন বিরতির পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান শুনানিতে অংশ নেন। রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. জসিম সরকার ও নূর মুহাম্মদ আজমী উপস্থিত ছিলেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আজিজুর রহমান বলেন, চারজন সাক্ষীর বরাত দিয়ে অমর্তে৵র বিরুদ্ধে বিচারিক আদালত রায় দিয়েছেন। অস্তিত্বহীন জবানবন্দি। কেননা, চার সাক্ষীর কেউই বলেনি যে অমর্ত্য হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও আঘাত করেছে। অথচ রায়ে বলা হয়েছে, অংশগ্রহণ করেছে, যা জালিয়াতির শামিল।
প্রত্যুত্তরে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সাক্ষী যা বলেননি, তা বিচারিক আদালতের রায়ে আলোচনা করা হয়েছে বলে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেছেন। এখানে কোড–আনকোড উল্লেখ করা হয়নি। সাক্ষীর বক্তব্য সামারি করে বলা হয়েছে। সাক্ষীদের মধ্যে প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে প্রসিকিউশনের ঘটনাকে সমর্থন করেছেন। যে কারণে অন্যভাবে চিন্তা করার সুযোগ নেই। সাধারণ পরিবারের সদস্য আবরারের বিরুদ্ধে তখন বিরোধীপক্ষের একটি রাজনৈতিক দলের ট্যাগ দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে ওই সময় সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ কোনো সাক্ষীকে প্রভাবিত করবে—এমন মনে করা হলে সে ক্ষেত্রে বক্তব্য হচ্ছে, এটি ভ্রান্ত ব্যাখ্যা। এটি বিভ্রান্ত করার জন্যই বলা হচ্ছে। এ মামলায় আটজন আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবাবনবন্দি দিয়েছেন, যা একে অপরকে সমর্থন করে। এখানে পরিস্থিতিগত প্রমাণাদি এবং আবরারকে কীভাবে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, কারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল—সেগুলোও একটি অন্যটিকে সমর্থন করে।
ফৌজদারি কোনো মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে কারও মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যেটি ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা জেল আপিল, নিয়মিত আপিল করতে পারেন। সাধারণত ডেথ রেফারেন্স ও এসব আপিলের ওপর একসঙ্গে হাইকোর্টে শুনানি হয়ে থাকে।
ওই মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের পর কারাগারে থাকা দণ্ডিতরা কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জেল আপিল ও আপিল করেন। পৃথক জেল আপিল গ্রহণযোগ্যতার ওপর শুনানির জন্য ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি হাইকোর্টে ওঠে। সেদিন হাইকোর্ট আসামিদের জেল আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। পাশাপাশি নিয়মিত আপিল করেন কারাগারে থাকা দণ্ডিতরা। আসামিদের এই ডেথরেফারেন্স, জেল আপিল ও আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি চলছে। গত বছরের ২৮ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে শুনানি শুরু করে। এরপর পেপারবুক থেকে উপস্থাপনের মাধ্যমে ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে পুনরায় শুনানি হয়।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় আবরারের বাবা চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। তা আমলে নিয়ে ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। আসামিদের মধ্যে ২২ জনকে রায়ের দিন আদালতে আনা হয়। পলাতক তিনজন। আসামিরা সবাই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতা-কর্মী।